এখন থেকে চাইলেই নিরস্ত্র পরিদর্শকরা (ইন্সপেক্টর) থানার ওসি (অফিসার ইনচার্জ) হতে পারবেন না। মানদণ্ড হিসেবে ১১ ধরনের যোগ্যতা থাকলেই পরিদর্শক পদমর্যাদার যেকোনো পুলিশ সদস্যকে থানার ওসি পদে পদায়ন করা যাবে। এই যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য করা হবে ‘ফিটলিস্ট’। সেটি অনুসারেই ওসি পদে পদায়ন করা হবে। এই ‘ফিটলিস্ট’ প্রণয়নের জন্য করা হয়েছে সিলেকশন কমিটি। সাত সদস্যের কমিটির প্রধান করা হয়েছে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত আইজিপিকে (এইচআর এম)। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ইতিপূর্বে ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যরা থানার ওসি পদে পদায়ন হতেন। কোন কোন ক্ষেত্রে লেনদেনের মাধ্যমেও ওসি পদায়ন হতো। এছাড়া নানা তদবিরের চাপে পড়ে ওসি পদায়ন ছিল বিগত দিনের আলোচিত ঘটনা। নানা উপায়ে ওসি পদে নিয়োগ পেয়ে থানায় যোগদান করেই মাঠে নেমে পড়তেন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে। বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন করে হয়ে উঠতেন এক একজন সাম্রাজ্যের অধিকারী। ফলে বিত্ত-বৈভবের অভাব হতো না। থানার ওসি মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের নিয়ে লাঠিয়াল বাহিনীর ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সরকারী দলের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে গোটা বাহিনীকে ফেলেছেন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। এমন ধরনের ভুরি ভুরি মন্দ অভিজ্ঞতা থেকেই পুলিশ প্রশাসন নতুন চিন্তা-ভাবনা করছে।
পুলিশ সদর দফতরের পার্সোনাল ম্যানেজমেন্ট শাখা সূত্র জানায়, থানার ওসি পদে পদায়নে পুলিশ নিরস্ত্র ইন্সপেক্টরদের ফিটলিষ্ট তৈরির কার্যক্রম শুরু করেছে পুলিশ সদর দফতর। এরই অংশ হিসেবে অতিরিক্ত আইজি (এইচআরএম) কে প্রধান করে সাত সদস্যের একটি সিলেকশন কমিটি গঠন করা হয়েছে পুলিশের আইজির নির্দেশে সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে। এই কমিটিকে ওসি হতে প্রত্যাশী পুলিশ ইন্সপেক্টরদের কয়েক ধাপে মান যাচাইয়ের পর নির্ধারিত মানদণ্ডে উত্তীর্ণদের ফিটলিস্টভুক্ত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ ইন্সপেক্টরদের থানার ওসি হিসেবে পদায়ন করতে জেলা প্রশাসকদের মতো ফিটলিস্ট করতে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ছিল। সেই সুপারিশ বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে।
এর আগে গত ১৬ এপ্রিল থানার ওসি পদায়নে বাংলাদেশ পুলিশের পলিসি গ্রুপের এক সভায় গৃহিত সিদ্ধান্তানুসারে ৩ জুলাই ওসি পদায়ন নীতিমালা করা হয়। ওই নীতিমালার আলোকে উপযুক্ত পুলিশ ইন্সপেক্টরদের থানার ওসি হিসেবে পদায়নের এই ফিটলিস্ট প্রণয়নের সিলেকশন কমিটি গত ৩ সেপ্টেম্বর গঠন করা হয়।
সূত্রে জানা গেছে, সিলেকশন কমিটিকে ফিটলিস্ট তৈরি করতে ৬টি বিষয় দেখার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এগুলো হলো-প্রতি বছর কমপক্ষে একবার ফিটলিস্ট প্রণয়ন সংক্রান্ত সভার আয়োজন; পুলিশ ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র)-দের সার্ভিস রেকর্ড যাচাই-বাছাই; সততা, মেধা, দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতা, প্রশিক্ষণ ও সন্তোষজনক চাকরি বিবেচনায় নিতে হবে; ফিটলিস্ট প্রণয়নে পুলিশ সদর দপ্তর প্রণীত মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ; বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন যথাযথভাবে বিবেচনা নেওয়া এবং পুলিশ স্টেশন ম্যানেজমেন্ট কোর্স (পিএসএমসি) ও শারীরিক সক্ষমতা বিবেচনায় নিতে হবে সিলেকশন কমিটিকে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, থানার ওসি পদায়নের জন্য ফিটলিস্ট তৈরিতে পরিদর্শকদের দক্ষতা ও তথ্য প্রযুক্তিগত সম্যক জ্ঞান হিসেবে ১১ ধরনের যোগ্যতা মানদন্ড হিসেবে বিবেচনা করা হবে। দক্ষতা হিসেবে লাগবে, সততা ও নৈতিকতা, আইন-শৃংখলা রক্ষা ও অপরাধ দমনে দক্ষতা, প্রশাসনিক ও পেশাদারিত্ব কাজে সক্ষমতা, প্রজ্ঞা ও ভাষাজ্ঞান, পরিচ্ছন্ন ভাবমর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব এবং বিনয়ী, গণমুখী ও সেবাধর্মী আচরণ। তথ্য ও প্রযুক্তিগত সম্যক জ্ঞানের মধ্যে লাগবে, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, সিডিআর ও সিডিএমএস বিশ্লেষন, ফরেনসিকসহ অন্যান্য রিপোর্ট বিশ্লেষন ও সোশ্যাল মিডিয়া বিশ্লেষন। অত্যুত্তম, উত্তম, চলতিমান ও চলতিমানের নিচে-এই চার ক্যাটাগরিতে মানদণ্ড নির্ধারিত করবে সিলেকশন কমিটি।
সিলেকশন কমিটির একজন সদস্য গতকাল সোমবার দৈনিক সংগ্রামকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারা এখন বিভাগীয় পদোন্নতি ও নির্বাচনি ট্রেনিং নিয়ে ব্যস্ত। এ কাজ শেষ হলেই থানার অফিসার ইনচার্জদের ফিটলিষ্ট তৈরির কাজ শুরু করবেন।
কারা থানার ওসি হতে পারবেন আর কারা পারবেন না এ বিষয়ে গত ৩ জুলাই মহাপুলিশ পরিদর্শক বাহারুল আলম একটি নীতিমালা জারি করেন। ওই নীতিমালা অনুযায়ী, ৫৪ বছরের ঊর্ধ্বে বয়সী কোনো ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) এখন থেকে আর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে নিয়োগ পাবেন না। এছাড়া আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনজনিত কারণে কোনো ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) সমগ্র চাকরিজীবনে ১টি গুরুদত্তপ্রাপ্ত হলে তিনি ওসি হিসেবে পদায়নের অযোগ্য হবেন। ওসি হিসেবে সর্বোচ্চ ৪টি থানা বা ৬ (ছয়) বছর দায়িত্ব পালন করলে (যেটি আগে ঘটে) পরবর্তীতে তিনি আর থানার ওসি হিসেবে পদায়নের জন্য বিবেচিত হবেন না। আবার টানা তিন বছরের বেশি কোন ইন্সপেক্টর একই থানায় ওসি হিসেবে থাকতে পারবেন না।
নীতিমালা বলছে, থানার ওসি পদে পদায়নে ফিস্টলিস্টভূক্ত হওয়ার পর পুলিশ স্টেশন ম্যানেজমেন্ট কোর্স (পিএসএমসি)’ সম্পন্ন করাতে হবে। কোনো কর্মকর্তাকে থানার ওসি হিসেবে পদায়নের ক্ষেত্রে তার প্রশিক্ষণের ফলাফল মূল্যায়ন করা হবে। থানার ওসি পদে পদায়নের জন্য পিইটিতে উত্তীর্ণ হওয়ার শর্ত প্রয়োজন নেই। তবে ফিটলিস্টভূক্ত করার ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের শারীরিক সক্ষমতার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। থানার ওসি পদে পদায়নের ক্ষেত্রে বিগত পাঁচ বছরের এসিআর-এ গড়ে ন্যুনতম ৮০ নম্বর থাকতে হবে। তবে বিগত তিন বছরের এসিআর-এ কোনো ‘বিরূপ মন্তব্য’ থাকলে ওসি হিসেবে পদায়নের অযোগ্য বিবেচিত হবে।
নীতিমালা অনুযায়ী অফিসার ইনচার্জ হিসেবে দুই বছর চাকরি করার পর অন্যত্র বদলি করা যাবে। এক্ষেত্রে একই থানায় ধারাবাহিকভাবে সর্বোচ্চ ৩ (তিন) বছর চাকরি করার সুযোগ থাকবে। এছাড়া কোনো থানার ওসিকে ১৮ মাসের পূর্বে অন্যত্র বদলির প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট রেঞ্জ ডিআইজি, পুলিশ কমিশনারগণ নিজ অধিক্ষেত্রের মধ্যে অন্যত্র বদলি, প্রত্যাহার এবং সংযুক্ত করতে পারবেন। এক্ষেত্রে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হবে না। একটি থানার কর্মকাল গণনায় ন্যুনতম ছয় মাস ধারাবাহিকভাবে চাকরি করতে হবে। তবে কোনো অভিযোগ বা বিচ্যুতির প্রমাণকসহ প্রতিবেনের ভিত্তিতে মাসের পূর্বে প্রত্যাহার হলে উক্ত থানা গণনার জন্য বিবেচিত হবে। পূর্বের কর্মস্থল, জেলা পুলিশ বা ইউনিটে ওসি হিসেবে পদায়ন বা বদলি করা যাবে না।