আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের সরকারি বাসভবনে একটি ‘ ড্রোন’ ( মনুষ্যবিহীন আকাশযান) পাওয়া গেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সিটিটিসির সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন‘র ডিজিটাল ফরেনসিক টিম ড্রোনটি উদ্ধার করে তা পরীক্ষার জন্য ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়েছে। কোথা থেকে কিভাবে এই ড্রোনটি কারা পাঠিয়েছে, তা নিয়ে চলছে তদন্ত। এ ঘটনার পর আইন উপদেষ্টার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর ও ডিএমপির নির্ভরযোগ্য সুত্রে এ খবর জানা গেছে।

জানতে চাইলে গতকাল শনিবার রাতে ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী দৈনিক সংগ্রামকে ড্রোন উদ্ধারের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এটি এখন যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।

সুত্রগুলো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে দৈনিক সংগ্রামকে জানায়, গতকাল ২৬ এপ্রিল শনিবার সকাল ৮.৪৫ মিনিটের দিকে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের সরকারি বাসভবন ৩৫, হেয়ার রোড, রমনা, ঢাকা এর মূল বিল্ডিংয়ের পশ্চিম দিকে ১৫০ গজ সামনে বাগানের মধ্যে পুরাতন মোটা আম গাছ হতে ৭ ফুট উত্তর-পূর্ব দিকে ঘাসের উপর একটি ড্রোন বন্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। এ সময় বাগানের মালী সালমা হক বাগান ঝাড়ু দেয়ার সময় ড্রোনটি দেখতে পেয়ে সেটি আইন উপদেষ্টার পার্সোনাল অফিসার দেলোয়ার হোসেন‘র নিকট বুঝিয়ে দেয়। সংবাদ পেয়ে ১০.৩০ মিনিটের দিকে ডিজিটাল ফরেনসিক টিম, সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন, সিটিটিসি, ডিএমপির একটি টিম ঘটনাস্থলে পৌছে। আইন উপদেষ্টার পার্সোনাল অফিসার‘র কাছ থেকে ড্রোনটি সংগ্রহ করে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় ড্রোনটি dji Mavic Mini, Model: dji MT1SD25, Made in China এর একটি ড্রোন, যার টেকঅফ ওজন ২৪৯ গ্রাম। ড্রোনটিতে ফুটেজ সংগ্রহ করার মত কোন মেমোরী কার্ড পাওয়া যায়নি এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে ড্রোনের ব্যাটারী খোলা ছিল। বাসভবনের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনায় একটি ক্যামেরাতে ড্রোনটি আগের দিন ২৫ এপ্রিল শুক্রবার সন্ধ্যা ১৭.২৯ মিনিটের সময় অবতরণ করতে দেখা যায়। অন্যান্য সিসি ক্যামেরার ফুটেজে ড্রোনটি পরিলক্ষিত হয়নি বলে সুত্রের দাবী। বর্তমানে ড্রোনটি সিটিটিসি এর সিটি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের ফরেনসিক টিম ফরেনসিক করানোর উদ্দেশ্যে ফরেনসিক ল্যাবে নিয়ে গেছে।

উদ্ধারকৃত ড্রোনটির মডেল নাম্বার অনুসারে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের বরাতে জানা যায়, dji Mavic Mini, Model: dji MT1SD25, একটি ডিজেআই কর্তৃক চীনে নির্মিত কমপ্যাক্ট এবং পোর্টেবল ড্রোন। এটি ব্যক্তিগত এবং বাণিজ্যিক আকাশযান ফটোগ্রাফি এবং ভিডিওগ্রাফির জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, অনেক দেশে নির্দিষ্ট নিবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করে ২৫০ গ্রামের কম ওজনের সমস্ত রূপ ব্যবহার করা হয়। Mavic Mini-তে একটি ১/২.৩” সেন্সর ক্যামেরা রয়েছে যা ২.৭K ভিডিও এবং ১২ MP ছবি ক্যাপচার করে, এবং চিত্র স্থিতিশীলকরণের জন্য একটি ৩-অক্ষের গিম্বাল রয়েছে। এতে একটি নি¤œগামী দৃষ্টি ব্যবস্থা, ইনফ্রারেড সেন্সিং সিস্টেম এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়ি ফিরে আসার মতো বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। এর মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কমপ্যাক্ট এবং পোর্টেবল: ২৫০ গ্রামের কম ওজনের, এটি প্রায় স্মার্টফোনের মতো হালকা। ব্যবহারে সহজ: DJI Fly অ্যাপটি একটি সহজ এবং স্বজ্ঞাত ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা প্রদান করে। ফ্লাইট টিউটোরিয়াল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যবহারকারীদের দ্রুত এবং নিরাপদে শুরু করতে সাহায্য করার জন্য একটি অন্তর্নির্মিত বৈশিষ্ট্য। ভিডিও এবং উচ্চমানের ছবি তোলে। চিত্র স্থিতিশীলতা প্রদান করে। নিম্নমুখী দৃষ্টি ব্যবস্থায় ঘোরাফেরা এবং উড়ানের স্থায়িত্ব বাড়ায়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে শুরুর স্থানে ফিরে যায়। সর্বোচ্চ ফ্লাইট সময় বলা আছে ৩০ মিনিট পর্যন্ত।

উইকিপিডিয়ায় দেখা যায়, ‘ড্রোন’ হচ্ছে, মনুষ্যবিহীন আকাশযান (ইংরেজি:unmanned aerial vehicle, সংক্ষেপে: UAV) হচ্ছে দূরবর্তী কোনো স্থান থেকে পরিচালিত বা সরাসরি মনুষ্য নিয়ন্ত্রকবিহীন স্বয়ংক্রিয় বিমান পরিচালনা ব্যবস্থা। এটি এমন একটি সামরিক প্রযুক্তি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রকবিহীন বিমান ব্যবস্থার মাধ্যমে দুরবর্তী স্থানে হামলা চালানোসহ গোয়েন্দা নজরদারি করা যায়। মনুষ্যবিহীন আকাশযান ও মিসাইলের মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে, মিসাইলে যেখানে দুর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হলেও জ্বালানি ব্যবস্থা পরনির্ভর কিন্তু মনুষ্যবিহীন আকাশযান বায়ুর গতিবেগ ও আবহাওয়ার ক্রিয়া কৌশালাদির উপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়। বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত ড্রোন হচ্ছে মনুষ্যবিহীন বিমান প্রকৃতির, বা দুরনিয়ন্ত্রিত চালকবিহীন বিমান বা যন্ত্র। এর সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সামরিক কার্যাদিতে। প্রচলিত বিমানযুদ্ধে পাইলটের জীবনহানি বা শত্রুর হাতে বন্দী হওয়ার যে আশঙ্কা থাকে তা এড়াতেই এই পাইলটবিহীন যুদ্ধবিমান। ড্রোন শব্দের আভিধানিক অর্থ হল গুঞ্জন। এর চলার শব্দের সাথে মৌমাছির গুনগুনের মিল থাকার কারণেই এই নাম।

বাংলাদেশের প্রথম ড্রোন আকাশে ওড়ে ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি বুধবার। সেদিন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবি) পরীক্ষামূলকভাবে উড়ান হয়েছে চালকবিহীন বিমান ড্রোন। বেলা ১টা ২৭ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে এ ড্রোনটির উড্ডয়ন হয়। ছাত্রদের প্রচেষ্টায় এ যন্ত্রটি তৈরি করা হয়।

ড্রোন নিয়ে যত আইন : দেশে দেশে ড্রোন চালানোর ক্ষেত্রে নানা আইন রয়েছে। ড্রোন আকাশে উড়ে বেড়ায়। জমিন থেকে এর নিয়ন্ত্রণ করেন শুধুই ড্রোন পাইলট। তাই ড্রোন দিয়ে যেন কোনো অবৈধ বা অনৈতিক কাজ না করা যার, তার জন্য এ নিয়ে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে বিশ্বব্যাপী। এ দেশেও ড্রোন নিয়ে আইন রয়েছে।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ২০২০ সালে ড্রোন নিবন্ধন ও উড্ডয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করে। এই আইনের আওতায় ড্রোনকে ক, খ, গ ও ঘ- চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। ক শ্রেণির ড্রোন শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য ব্যবহার করা যাবে। খ শ্রেণির ড্রোন শিক্ষা ও গবেষণার মতো অ-বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা যাবে। গ শ্রেণির ড্রোন ব্যবহার করা যাবে সার্ভে, ছবি ও ভিডিও তোলা, উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে; এবং ঘ শ্রেণির ড্রোন ব্যবহৃত হবে রাষ্ট্রীয় ও সামরিক প্রয়োজনে।

ড্রোন ওড়ানোর জন্য তিনটি এলাকা চিহ্নিত করা হয়। এগুলো হচ্ছে, গ্রিন, ইয়েলো এবং রেড জোন। গ্রিন জোনে ড্রোন ওড়াতে কোনো অনুমতির প্রয়োজন হয় না। বিমানবন্দরের তিন কিলোমিটার দূরের সকল এলাকাই গ্রিন জোনের আওতাভুক্ত। ইয়েলো জোনের মধ্যে পড়ে সামরিক এলাকা, অধিক জনসংখ্যাভুক্ত এলাকা ও নিষিদ্ধ এলাকাসমূহ। এ এলাকায় অনুমতি সাপেক্ষে ড্রোন ওড়ানো যাবে। আর রেড জোনে ড্রোন চালানোর জন্য বিশেষ অনুমতি লাগবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষিত নিষিদ্ধ এলাকা, বিমানবন্দরসহ আরো কিছু এলাকাকে রেড জোনের আওতায় নেওয়া হয়েছে ।

এ দেশে ড্রোন আমদানী করা হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে আমদানি করার নির্দেশনা আছে ড্রোন আইনে। এছাড়াও, ড্রোন আইন অনুযায়ী, ড্রোন চালানোর জন্য ড্রোন নিবন্ধন করতে হবে ও অনুমোদনের কপি পাইলটকে সাথে রাখতে হবে। এমন আরো বেশকিছু আইন রয়েছে। যদিও সব আইন মেনে চলা হয় না এদেশে। হয় না আইনের যথাযথ প্রয়োগও। আবার এমন কিছু আইনও আছে, যেগুলো শখের ড্রোন পাইলটদের জন্য বাধা হিসেবে কাজ করে।