জাতীয় নির্বাচন, জাতীয়ভাবেই করতে হবে। ইসির একার পক্ষে সবকিছু সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। তিনি বলেছেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা শুধু নির্বাচন কমিশনের (ইসি) একার পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্য গণমাধ্যম, জনগণ এবং রাজনৈতিক দলসহ সবার সহযোগিতা অপরিহার্য। অপরদিকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনের আস্থার সংকট দূর করার আহ্বান জানিয়েছেন গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা। তারা বলেছেন, গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ও কমিশনের প্রতি জনগণের বিশ্বাসহীনতা ও আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। ভালো নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে এই আস্থার সংকট দূর করতে হবে। বির্তক এড়িয়ে রাজনৈতিক দল ও মানুষের আস্থা অর্জন করার পরামর্শ দিয়েছেন। সেই সাথে নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা, সাইবার নজরদারি, আর্থিক স্বচ্ছতা এবং সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেয়ার পরামর্শ দেন।

গতকাল সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আয়োজিত এক সংলাপে তিনি এসব কথা বলেন।

সিইসি বলেন, এই নির্বাচন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। তাই একটি ভালো নির্বাচন হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। ২০২৪ সালের নভেম্বরে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই তারা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার সময় ২১ লাখ মৃত ভোটার চিহ্নিত করে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রায় ৪৫ লাখ নতুন ভোটার যুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে, নারী ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ বাড়াতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হয়েছে, যার ফলস্বরূপ বিপুল সংখ্যক নারী নিবন্ধন করেছেন।

সংলাপে চার নির্বাচন কমিশনারÑআবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ, বেগম তাহমিদা আহমদ, আব্দুর রহমানেল মাছউদ ও মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার উপস্থিত ছিলেন। সকালে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিনিধিগন এবং বিকেলে প্রিণ্ট মিডিয়ার প্রতিনিধিগণ সংলাপে অংশগ্রহণ করেন।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের মধ্যে ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ, ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দিন, যুগান্তরের সম্পাদক আব্দুল হাই শিকদার, সংগ্রামের সম্পাদক আযম মীর শাহীদুল আহসান, কালের কণ্ঠের সম্পাদক হাসান হাফিজ, নয়া দিগন্তের নির্বাহী সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলী, খবরের কাগজের সম্পাদক মোস্তফা কামাল, আজকের পত্রিকার সম্পাদক কামরুল ইসলাম, প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ, ঢাকা মেইলের নির্বাহী সম্পাদক হারুন জামিল, দৈনিক আমাদের সময়ের নির্বাহী সম্পাদক এহসান মাহমুদ, বাংলাবাজার পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক রাশেদুল হক ও খবর সংযোগের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক শেখ নজরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

বাসসের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ, বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোরের সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক আবু তাহের, প্রতিদিনের বাংলাদেশের সম্পাদক মারুফ কামাল খান, ইউএনবির সম্পাদক মাহফুজুর রহমান, বাংলাদেশ বেতারের পরিচালক মো. বশির উদ্দিন, সারাবাংলাডট নেটের হেড অব নিউজ গোলাম সামদানী, দ্য ডেইলি স্টারের হেড অব নিউজ জিয়াউল হকও সংলাপে উপস্থিত ছিলেন।

উপস্থিত ছিলেন যায়যায়দিনের যুগ্ম সম্পাদক মো. মাহমুদুজ্জামান, দৈনিক আমার দেশের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, ইত্তেফাকের রাজনীতি ও নির্বাচন বিষয়ক সম্পাদক সাইদুর রহমান, রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসির (আরএফইডি) সভাপতি কাজী এমাদ উদ্দিন জেবেল ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীও।

কালের কণ্ঠের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্যে বলেন, প্রত্যাশা থাকবে আপনারা মেরুদণ্ড সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে জাতির কাছে পৌঁছাবেন। এটি দেশকে নতুন করে গড়ার একটি বিরল সুযোগ। যা হয়তো ৫০ বা ১০০ বছরে আসবে না। তিনি ইসির প্রস্তুতি ডু অর ডাই মনোভাব নিয়ে দৃঢ়তার পরিচয় দেওয়ার আহ্বান জানান।

অতীতের নির্বাচন পরিচালনাকারীরা এখন কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইসির সামনেও একই ধরনের আশঙ্কা রয়েছে।

হাসান হাফিজ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে ইসির প্রতি কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেন। তিনি রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, তরুণ এবং গণ্যমান্য শিক্ষকদের নিয়ে একটি নজরদারি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন। তার মতে, এটি নির্বাচন কমিশনের কাজ অনেকাংশে সহজ করবে এবং সবার মধ্যে দায়িত্ববোধ তৈরি হবে। এছাড়া তিনি সাইবার নজরদারি বাড়ানোর ওপর জোর দেন।

তিনি উল্লেখ করেন, এআই ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে সক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনে বিদেশি সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

দৈনিক সংগ্রামে সম্পাদক আযম মীর শাহীদুল আহসান বলেন, নির্বাচনে লেবেল প্লেইং ফিল্ড এর জন্য নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে হবে। যতটা সম্ভব বির্তক এড়িয়ে চলতে হবে। আর আইন শৃংখলার কথা বিবেচনা করে একাধিক দিনে নির্বাচন করা যায় কিনা এ বিষয়টি ইসি বিবেচনা করে দেখতে পারে বলে তিনি পরামর্শ দেন।

নয়া দিগন্তের নির্বাহী সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলী বলেন, নির্বাচনকে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করতে হবে। এ জন্য কালোটাকার মালিক, ঋণ খেলাপী, কর খেলাপী ব্যক্তিরা যাতে নির্বাচন করতে না পারে এ জন্য আইনী পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ তার বক্তব্যে নির্বাচনের বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, জাতি ১৫ বছর পর একটি স্বচ্ছ ও আনন্দময় নির্বাচনের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে, এবারের নির্বাচনে অর্থ ও পেশিশক্তির ব্যাপক প্রয়োগের আশঙ্কা রয়েছে। তিনি প্রশাসনের দুর্বলতা ও আন্ডারহ্যান্ডলিংয়ের মাধ্যমে প্রার্থী কেনা-বেচার মতো বিষয়গুলো নিয়ে ইসির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বিশেষভাবে ডিজিটাল স্পেসে অর্থ প্রয়োগের মাধ্যমে জনমত তৈরির বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি হলফনামা ও নির্বাচনী ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়ে বলেন, ইসিকে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে এবং দু-একটি ক্ষেত্রে নজির স্থাপন করে নৈতিক শক্তির পরিচয় দিতে হবে।

আজকের পত্রিকার সম্পাদক কামরুল হাসান প্রার্থীর হলফনামা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা ওয়েবসাইটে আপলোড করার দাবি জানান। তিনি বলেন, এতে ভোটাররা প্রার্থীর সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য দ্রুত জানতে পারবে। একই সঙ্গে তিনি নির্বাচন কমিশনকে কোনো ধরনের গোপন নির্দেশনা না দেওয়ার অনুরোধ করেন, যা স্বচ্ছ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিকে ক্ষুণ্ন করতে পারে।

দ্য ডেইলি স্টারের হেড অব নিউজ জিয়াউল হক ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকদের অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করার দাবি জানান। তিনি বলেন, সাংবাদিকরা যেন ভোটকেন্দ্রের ভেতরে কোনো ধরনের বাধা বা হয়রানির শিকার না হন এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।

বাসস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ বলেন, আমরা আশা করব, নির্বাচনের আগে যে অর্থের খেলা শুরু হয়-মনোনয়ন বাণিজ্য, ভোট কেনা, এমনকি কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করার মতো কর্মকাণ্ড-এসব কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে।

ঢাকা মেইলের নির্বাহী সম্পাদক হারুন জামিল বলেন, বিগত তিনটা নির্বাচন ভোটার ছাড়া নির্বাচন হওয়ার কারণে নির্বাচনের ওপরে মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। এ আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারলে নির্বাচন কমিশন সফল হবে। আমাদের দেশে নির্বাচন ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো গত তিনটা নির্বাচন মানে ভোটার ছাড়া নির্বাচন হওয়ার কারণে নির্বাচনের উপরে মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশনের প্রথমেই উচিত আস্থাটা ফিরিয়ে আনা।

গণমাধ্যমের এই শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা মনে করেন, ইসি যদি তাদের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনাগুলো আমলে নেয় এবং স্বচ্ছভাবে নির্বাচন পরিচালনা করে, তাহলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব হবে। তাদের প্রত্যাশা, ইসি জাতির সামনে তার দৃঢ়তার পরিচয় দেবে।

যমুনা টিভির জ্যেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, প্রশাসন ও পুলিশের দায়-দায়িত্ব ইসিকে নিতে হবে। মাঠের কর্মকর্তাদের মধ্যে ভয় কাজ করে, তারা ভোটের পর ক্ষমতাসীন দলের রোষানলে পড়তে পারেনÑএমন ধারণা পরিবর্তন করতে হবে।

ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক মোস্তফা আকমল বলেন, নির্বাচনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার। এক মিনিটেই ভুয়া ছবি তৈরি করা যায়, প্রার্থীদের ভাবমূর্তি নষ্ট করা সম্ভব। তিনি ভোটার তালিকা হালনাগাদে ত্রুটি দূর করা ও ফলাফল দ্রুত প্রকাশের আহ্বান জানান।

চ্যানেল আইয়ে চিফ নিউজ এডিটর জাহিদ নেওয়াজ খান বলেন, সঠিক তথ্য দ্রুত প্রকাশ করা গেলে গুজব কমবে। আমরা মাঠে যাই বিশৃঙ্খলার খবর পেতে। তাই ইসি যত দ্রুত ফলাফল দেবে, তত দ্রুত আমরা প্রচার করতে পারব।

ডিবিসি টিভির সম্পাদক লোটন একরাম বলেন, সংস্কার কমিশন অনেক কাজ এগিয়ে দিয়েছে। এজন্য আপনারা অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ দেরি করছেন। কিন্তু আমরা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে যে প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম সেগুলো আমলে না নিয়েই যদি নীতিমালা করেন তাহলে তো আজকের এই সংলাপ ফলপ্রসূ হলো না। কাজেই নীতিমালা সংশোধন করা উচিত।

জাহিদ নেওয়াজ বলেন, লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। তথ্য গোপন করা হয়, ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। হলফনামা যেটা দিল আমরা জানি ভুয়া, কিন্তু ইসি আর সেটা তদন্ত করে দেখল না, সেটা হলে তো আর হলফনামা দেওয়ার দরকার নেই। স্যোশাল মিডিয়ার বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

এটিএন নিউজের হেড অব ইনপুট শহিদুল আজম বলেন, নিবন্ধিত গণমাধ্যম নিয়ম মেনে চলে, কিন্তু ইউটিউব বা মোবাইলভিত্তিক প্ল্যাটফর্মে খবর ছড়ানো ঠেকানো কঠিন। তাই ইসির তথ্য শাখাকে শক্তিশালী করতে হবে। তিনি বলেন, যা চাপিয়ে রাখা যাবে না, সেটি উন্মুক্ত করাই ভালো। তাহলে সন্দেহ থাকবে না।