# ২২ মামলায় ১৪১ জন আসামী
# পরোয়ানার পর ২২ জন আসামী পালিয়েছে
# গ্রেফতার ৫৭ পলাতক ৮৪
# বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত করতে ষড়যন্ত্র
# তদন্ত দলকে হত্যার চেষ্টা
# ১০ জনের নামে রেড নোটিশের চিঠি
জুলাই গণহত্যার বিচারে ট্রায়াল শুরু করতে চার্জশিটের জন্য অপেক্ষা করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। চার্জশিট পাওয়ার পর পরই মূল বিচার কাজ শুরু করবে এ আদালত। এখন পর্যন্ত ২২ মামলায় ১৪১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রধান আসামী শেখ হাসিনাসহ অধিকাংশই পলাতক। মাত্র ৫৭ জন আসামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবু বিশাল সংখ্যক আসামীকে পলাতক রেখেই আইনের ধাপ অনুসরণ করে সাক্ষ্য গ্রহণের মাধ্যমে মূল বিচার কাজ শুরু করবে বলে ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে।
সূত্রমতে, জুলাই বিপ্লবের পর ৯ মাস অতিবাহিত হচ্ছে। এখনো একটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে দাখিল হয়নি। জুলাই গণহত্যায় দেড় থেকে দ্ইু হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের গ্রহণযোগ্য বিচার নিশ্চিত করতে আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়েছে। এ ট্রাইব্যুনালে প্রায় দুই হাজার হত্যাকাণ্ডের বিপরীতে এখন পর্যন্ত অভিযোগ দায়ের হয়েছে ৩৩৯টি। এসব অভিযোগ থেকে তদন্তকারী সংস্থা মাত্র ৩৯টি মামলা তদন্ত করছে। তার মধ্যে এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল ২২টি মামলা আমলে নিয়ে ১৪১ জন আসামীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৭০ জন সিভিলিয়ান, ৬২ জন পুলিশ এবং ৯ জন বিভিন্ন সেনাবাহিনীর সদস্য। গ্রেফতারী পরোয়ানা জাারির পর ৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ৮৪ জন এখনো পলাতক। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর ২২ জন আসামী পালিয়ে গেছে। এছাড়াও বিশাল সংখ্যক আসামীর বিরুদ্ধে এখনো অভিযোগ আমলে নেয়া হয়নি এবং গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করা হয়নি। এসব অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে।
প্রসিকিউশন সূত্র জানিয়েছে, পলাতক আসামীদের গ্রেফতার করতে ইতোমধ্যে যাবতীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিদেশে পালিয়ে যাওয়া আসামীদের ধরার জন্যও চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে শীর্ষ দশজন আসামীর জন্য ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করার জন্য আইজিপিকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে এখনো কারো বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা হয়নি। রেড নোটিশের জন্য পাঠানো দশ আসামীরা হলেন, সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, হাছান মাহমুদ, জাহাঙ্গীর কবীর নানক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আছাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, সাবেক মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, নসরুল হামিদ বিপু ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিকী।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন থেকে জানা গেছে, ট্রাইব্যুনাল বেশকিছু মামলার বিচার কাজের প্রাথমিক ধাপ সম্পন্ন করেছে। এখন ট্রায়াল শুরু করতে চার্জশিটের অপেক্ষা করছে। চার্জশিট পাওয়া মাত্রই মূল বিচারকাজ শুরু হবে। ট্রাইব্যুনালে করা মামলার তদন্তে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০০ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনে সময় ছাত্র জনতার ওপর সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের ঘটনার ভিডিও ও ডিজিটাল সাক্ষ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ১০০০-এর বেশি ভিডিও ক্লিপস সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলোর পর্যালোচনা, ভেরিফিকেশন এবং জিওলোকেশন যাচাইয়ের কাজ চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে। আরো জানা গেছে, ইতোমধ্যে চারটি মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যাায়ে। চলতি মাসেই এ চারটি মামলার চার্জশিট দাখিল হতে পারে। এ মামলাগুলো হলো, গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের হওয়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা, সাভারের আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর ঘটনা, রাজধানীর চানখাঁরপুলে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এবং রামপুরায় কার্নিশে ঝুলে থাকা এক ব্যক্তির ওপর গুলীবর্ষণের ঘটনা।
প্রসিকিউশন থেকে জানা গেছে, গণহত্যার বিচার কাজ বাধাগ্রস্ত করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র হচ্ছে। একের পর এক তথ্য পাচারে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম। এ তথ্য পাচারের কারণে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর ২২ জন আসামী পালিয়ে যান। গোপন তথ্য কীভাবে ফাঁস হচ্ছে, তা তদন্তে গঠন করা হয়েছে কমিটিও। এই তথ্য ফাঁসে ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে জড়িত বা প্রসিকিউশনের কেউ যদি তথ্য ফাঁসে জড়িত থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া ঘোষণাও প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে। তবে এখনো এ বিষয়ে কাউকে অভিযুক্ত করা যায়নি।
এদিকে ট্রাইব্যুনালের খোদ চিফ প্রসিকিউটর এডভোকেট তাজুল ইসলাম অভিযোগ করেছেন, তদন্ত সংস্থাকে হত্যা করার জন্য বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, আমিসহ গুমের মামলার তদন্তে যাওয়া দলের সদস্যদের হত্যার উদ্দেশ্যে টাইম বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে কোনো তথ্য উপাত্ত যেন ফাঁস না হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কাজ করছি। সকল ছিদ্র বন্ধ করার চেষ্টা করছি।
তিনি এ বিষয়ে বলেন, আমরা তদন্ত করতে গিয়েছিলাম গুমের বিষয়ে। সেখানে গিয়ে অনেক কিছু আমরা দেখেছি। টাইম বোমা দেখেছি। হয়তো এই টাইম বোমা সেট করা হয়েছিল তদন্তকারী দলকে হত্যার পরিকল্পনা নিশ্চিত করতে। আয়নাঘর পরিদর্শনে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। আমরা সেখানে গিয়ে অনেকগুলো ছবি তুলেছি। ছবিগুলো ভুক্তভোগীদের দেখিয়েছি। ভুক্তভোগীরা দেখে বুঝতে পেরেছেন এটাই ছিল আয়নাঘর। এই আয়নাঘরে ভুক্তভোগীদের নিয়ে টর্চার করা হতো। বোমা দেখে আমি আমার সঙ্গে থাকা প্রসিকিউটরকে সাবধান করি। বোমা টাচ না করতে বলি। পরে আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে আসি। আমরা আয়নাঘর পরিদর্শনের ঠিক দুইদিন পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেখানে পরিদর্শনে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি সেখানে আর যাননি। আয়নাঘরের অন্য জায়গায় পরিদর্শন করেছেন।
প্রায় দুই হাজার হত্যার বিপরীতে অল্পসংখ্যক আসামীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্পর্কে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা যেটা করতে চাই মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় মাস্টারমাইন্ড, প্ল্যানারস, সিনিয়র কমান্ডারের দায়দায়িত্বে যারা ছিলেন। টপ কমান্ডার যাদের কারণে এই ঘটনা ঘটেছে তাদের বিচার আগে করতে চাই। তারপরও যারা চিহ্নিত হয়েছে, সুপিরিয়র অফিসারের নির্দেশনার বাইরে গিয়ে গুলী করেছে- এই জাতীয় যারা সরাসরি অপরাধ করেছে। প্রধানত যার কারণে এই অপরাধ হয়েছে। যারা এটারা ডিজাইন (নকশা) করেছেন, প্ল্যান (পরিকল্পনা) করেছেন। যাবতীয় নির্দেশনা দিয়েছেন তাদের বিচার আগে হবে। আমরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।