বাংলাদেশি আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলম বলেছেন, ফিলিস্তিনে ফ্লোটিলা যাত্রার মূল উদ্দেশ্য ছিল গাজার অবরোধ ভাঙা। ইসরাইলীরা সেখানে সাংবাদিক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রবেশাধিকার অবরোধ করে রেখেছে। এই অবরোধ ভাঙাই ফ্লোটিলা যাত্রার মূল উদ্দেশ্য ছিল। ত্রাণ বিতরণ তো একটি সিম্বলিক মাত্র। তিনি বলেন, ত্রাণ দেওয়ার জন্য তো দেশটিতে শত শত ট্রাক অপেক্ষা করছে। প্রবেশ অধিকার পাচ্ছে না বলে সেই ত্রাণ প্রবেশ করতে পারছে না। ইসরাইলী বাহিনীর হাতে বন্দী থাকার সময়কার অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। তিনি বলেছেন, তাঁদের ওপর মানসিক অত্যাচার বেশি করা হয়েছে। জেলের ভেতরে আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা হয়েছে। এমনকি হামাসের সমর্থক দাবি করে তাঁদের একজন সহযাত্রীকে গুলী করে মারারও হুমকি দেওয়া হয়েছে।

গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর দৃক পাঠ ভবনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এমন অভিজ্ঞতার কথা জানান। গতকাল শনিবার ভোরে ইসরাইলের আটক দশা থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরেন তিনি। নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেন তিনি।

সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশি এই আলোকচিত্রী বলেন, ইসরাইলের অবরোধের কারণে সাংবাদিকদের কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। এতে সেখানকার প্রকৃত চিত্র জানা যাচ্ছে না। স্বাস্থ্যকর্মীদের অবাধ যাতায়াত করতে দেওয়া হচ্ছে না। আক্রান্ত ফিলিস্তিনবাসীর ওপর হসপিটালে আক্রমণ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য কর্মী ও মানবাধিকারকর্মীকে মেরে ফেলা হচ্ছে। আমরা প্রকৃতপক্ষে এই অবরোধ ভাঙার লক্ষ্যে গিয়েছিলাম। তিনি বলেন, যেখানে ইসরাইল নিজেদের মোরাল আর্মি হিসেবে নিজেদের দাবি করে, সেখানে তারা কীভাবে একটি জাতির ওপর এমন নির্যাতন করছে, এটা আমাদের প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক আইন কীভাবে তারা প্রতিদিন ভাঙছে, এটা আমাদের প্রশ্নের বিষয়।

শহিদুল আলম বলেন, আটক করে জাহাজ থেকে নামানোর পর তাঁদের ওপর অনেক ধরনের নির্যাতন করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে মানসিক নির্যাতন বেশি করা হয়েছে। তিনি বলেন, তাঁদের হাত পেছনে নিয়ে বেঁধে যেখানে হাঁটুমুড়ে বসানো হয়েছিল, সেখানে ইসরাইলী বাহিনী আগে থেকে মূত্রত্যাগ করেছিল। এরপর তাঁর বাংলাদেশি পাসপোর্ট ইসরাইলী বাহিনী ফেলে দেয়। তিনি যতবার সেটি তুলেছেন ততবার তাঁর ওপর চড়াও হয়েছে। সেসময় নিজেদের মধ্যে কথা বলায় অন্য দুজন সহযাত্রীকে মেশিনগানের ব্যারেল দিয়ে আঘাত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

শহিদুল আলম জানান, মরুভূমির মধ্যে ইসরাইলের সবচেয়ে গোপনীয় কারাগারে তাঁদের রাখা হয়। সেখানে অন্য জাহাজ থেকে আটক হওয়া আরেকজন সহযাত্রী তাঁকে জানান, ইসরাইলী বাহিনী ওই ব্যক্তিকে আটক করার পর বলেছিল ‘তুমি হামাসের এজেন্ট, ভেতরে নিয়ে তোমাকে গুলী করা হবে।’

শহিদুল আলম আরও বলেন, কারাগারে তাঁরা অনশন করেছিলেন। কোনো খাবার খাননি। তবে শারীরিক দুর্বলতার কারণে কয়েকজন খাবার খেয়েছেন। আড়াই দিনে তাঁদের মাত্র এক প্লেট খাবার দেওয়া হয়। তাঁদের যেখানে শুতে দেওয়া হয়েছিল, তা ছিল লোহার, শৌচাগারগুলোর অবস্থাও ছিল শোচনীয়। তিনি আরও বলেন, গভীর রাতে হঠাৎ করে ইসরাইলী বাহিনী মেশিনগান নিয়ে সেলের মধ্যে ঢুকে যেত। তারা জোরে আওয়াজ করত, চিৎকার করে দাঁড়ানো বা অন্য আদেশ দিত এবং আতঙ্ক তৈরি করার চেষ্টা করত।

এ সময় একজন সাংবাদিক পরবর্তী পরিকল্পনা জানতে চাইলে শহিদুল আলম বলেন, ‘অসাধারণ কিছু ব্যক্তি একসঙ্গে হওয়ার কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমরা এখন আন্তর্জাতিকভাবে একটা নেটওয়ার্ক দাঁড় করাব। যেহেতু গ্লোবাল লিডাররা করবে না, আমরা অ্যাকটিভিস্টরা কীভাবে করতে পারি সেই লড়াইয়ের প্রস্তুতি আমরা নিয়েছি।ৃ একটা ব্লুপ্রিন্ট আমরা করে রেখেছি এবং আমরা ফেরার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আবার আমরা যাব এবং হাজারটা জাহাজ যাবে। দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আমাদের দেশে যেটা করেছি জুলাই অভ্যুত্থানের সময় রাস্তায় নেমেছি, আন্দোলন করে এ রকম একজন স্বৈরাচারকেও আমরা হঠাতে পেরেছি। এখানেও সেই জিনিস, আন্তর্জাতিকভাবে সেরকম একটা জিনিস করা দরকার।

উল্লেখ্য যে, শনিবার ভোর ৪টা ৫৫ মিনিটে টার্কিশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান শহিদুল আলম। এর আগে শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টা ২৫ মিনিট) তাকে বহনকারী টার্কিশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট ইসরাইল থেকে ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে অবতরণ করে। তখন তাকে স্বাগত জানান ইস্তাম্বুলে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল মো. মিজানুর রহমান। পরে ইস্তাম্বুলের স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে টার্কিশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে শহিদুল আলম ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন।

ফিলিস্তিনে ইসরাইলের নৃশংসতা বন্ধ ও গাজায় ইসরাইলী নৌ অবরোধ ভাঙার প্রত্যয় নিয়ে ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন’ নামে একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম গাজা অভিমুখে ওই নৌযাত্রা শুরু করেছিল। ইসরাইলী আগ্রাসন বন্ধের দাবিতে আত্মপ্রকাশ করা আরেক উদ্যোগ থাউজেন্ড ম্যাডলিনস টু গাজার আটটি নৌযানও এ যাত্রায় অংশ নিয়েছিল। মোট ৯টি নৌযানের এ বহরে বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও অধিকার কর্মীরা যোগ দিয়েছিলেন। সেই দলে ছিলেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। গত বুধবার (৮ অক্টোবর) ওই নৌবহরে আক্রমণ করে সব অধিকার কর্মী ও নাবিককে ধরে নিয়ে যান ইসরাইলী সেনারা।

পরে শহিদুল আলমসহ আটক অনেককে ইসরাইলের কেৎজিয়েত কারাগারে নেওয়া হয়। ইসরাইলে আটক হওয়ার পর থেকেই শহিদুল আলমের মুক্তি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার জর্ডান, মিসর ও তুরস্কের মাধ্যমে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে আসছিল। কারামুক্ত হয়ে শহিদুল আলম ইসরাইল থেকে তুরস্কের উদ্দেশে যাত্রা করেন। শহিদুল আলমের মুক্তি ও ইসরাইল থেকে তার প্রত্যাবর্তনে সাহায্য করার জন্য তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।