জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত গত চার মাসে রাজধানীতে ১৩৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি ৩৮টি খুন হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) এ তথ্য জানিয়েছে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বাড্ডা থানাধীন গুদারাঘাট এলাকার একটি দোকানের সামনে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়ার সময় গুলশান থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল আহসান সাধনকে গুলী করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। হঠাৎ মাস্ক পরা দুই যুবক এসে প্রকাশ্যে একের পর এক গুলী করে হত্যা করে তাকে। পরে একাধিক ফাঁকা গুলী করে চলে যায় দুর্বৃত্তরা। এ হত্যাকা-ের একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। একইদিন রাজধানীর মগবাজারে প্রকাশ্য দিবালোকে চাপাতি দিয়ে আঘাত করে ছিনতাইকারীরা এক তরুণের ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়- এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ছিনতাইয়ের শিকার তরুণের নাম আবদুল্লাহ। এছাড়া গত মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বরে ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের পেছনের গলিতে এক মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীকে গুলী করে ২২ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন, দুর্বৃত্তরা তাকে গুলী করে এবং ছুরিকাঘাত করে তার কাছ থেকে ২১ লাখ ৭০ হাজার টাকা, তিন হাজার ৫শ’ ইউএস ডলার ও ১১শ’ সৌদি রিয়াল ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ওপরের তিনটি ঘটনাই ঘটে গত ১০ দিনের মধ্যে। শুধু বাড্ডা, মগবাজার কিংবা মিরপুরের ঘটনাই নয়, দেশজুড়েই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধীরা। প্রকাশ্যে খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, সশস্ত্র মহড়াসহ নানা অপরাধ কর্মকা- ঘটছে। মানুষকে জিম্মি করে, অস্ত্র ঠেকিয়ে, গুলী করে অথবা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। এতে মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে নিরাপত্তাহীনতা ও আতংক। এর আগে গত ১৯ মে রাতে ঢাকার সাভার থানাধীন ব্যাংক কলোনি এলাকায় শহীদ ইয়ামিন চত্বরের সামনে প্রকাশ্যে গুলী করে শাহীন (৩০) নামে এক যুবককে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। গত ১৮ মে রাতে রাজধানীর নিউমার্কেট থানাধীন সেন্ট্রাল রোডে এক যুবককে প্রকাশ্যে কোপানোর দুই মিনিট ছয় সেকেন্ডের এক ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
জানা গেছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জামিনে বের হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী ও দীর্ঘদিন বিদেশে পলাতক আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাফিয়ারা তৎপরতা বাড়িয়ে দেওয়ায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করা এসব সন্ত্রসীরা তাদের সহযোগীদের দিয়ে একের পর এক অপরাধ সংগঠিত করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে নিজেদের সক্ষমতার জানান দিচ্ছে। আবার আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে জড়াচ্ছে খুনোখুনিতেও। পুলিশ জানায়, ২০২৪ সালের প্রথম চার মাসে ঢাকায় খুন হন ৪৭ জন, ২০২৩ সালে ৫১, ২০২২ সালে ৫৪ ও ২০২১ সালের প্রথম চার মাসে ঢাকায় খুন হন ৫৫ জন। দেশের অন্য স্থানের তুলনায় রাজধানীতে অপরাধের মাত্রা বেশি। ডিএমপির ৫০টি থানায় বিভিন্ন অপরাধে গত জানুয়ারিতে এক হাজার ৭৯১টি, ফেব্রুয়ারিতে এক হাজার ৫৬৬, মার্চে ১৭শ’ ৫৪ ও এপ্রিলে ১৫শ’ ৪৭টি মামলা রুজু হয়েছে। সূত্র বলছে, প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীতে কোনো না কোনো চাঞ্চল্যকর অপরাধের ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, নবেম্বর থেকে এপ্রিল এই ছয় মাসে মহানগরীতে মামলা হয়েছে খুনের ঘটনায় ১৩৯টি, ডাকাতির ঘটনায় ৩৬টি, ছিনতাইয়ের ঘটনায় ২৪৩টি ও চুরির ঘটনায় ১ হাজার ২৮টি। তবে এ পরিসংখ্যান শুধু নথিভুক্তিতে। এর বাইরেও অনেক ঘটনা ঘটছে। খুনের ঘটনায় মামলা হলেও চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনায় অনেক ভুক্তভোগীই মামলা করেন না। অপরাধীরা জামিনে বের হয়ে কিংবা গোপন স্থান থেকে প্রকাশ্যে এসে এলাকায় নানাভাবে নিজের অবস্থান জানান দেওয়ার চেষ্টা করছেন। শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনও ছিলেন এই দলে। গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর হঠাৎ মগবাজারের বিশাল সেন্টারে আসেন সুব্রত বাইন। এতে বিপণি বিতানের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতংক তৈরি হয়। এলাকায় তার উপস্থিতির খবর ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে এ এলাকার চাঁদাবাজি ও খুন-জখমের একের পর এক ঘটনায় তার নাম আসতে থাকে।
এছাড়া পুলিশ গত এপ্রিলে সারা দেশে বিভিন্ন অপরাধে ১৬ হাজার ৩৬৮টি মামলা করেছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা ৩৩৬টি। এছাড়া ডাকাতির ৪৬, দস্যুতার ১৪৯, অপহরণের ৮৮টি ও ৭১৫টি চুরির মামলা। পুলিশ সদরদফতর সূত্র জানায়, মার্চ মাসে সারা দেশে বিভিন্ন অপরাধে ১৬ হাজার ২৪০টি মামলা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে সারা দেশে মামলা হয়েছে ১৩ হাজার দুটি। এর মধ্যে হত্যা মামলা ৩০০টি। এছাড়া ডাকাতির ৭৪, দস্যুতার ১৫৩, অপহরণের ৭৮ ও ৬৭৩টি চুরির মামলা। জানুয়ারি মাসে সারা দেশে বিভিন্ন অপরাধে ১৪ হাজার ৫৭২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা ২৯৪টি। এছাড়া ডাকাতির ৭১, দস্যুতার ১৭১, অপহরণের ১০৫, ৭৯৭টি চুরির মামলা। এছাড়া গত ২৪ দিনে সারা দেশে ২৩ জন পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।