১৬ বছর দুঃশাসন গুম-খুন ও লুটপাট দেখলাম : ড.উপদেষ্টা আসিফ নজরুল
মানবাধিকার কমিশনের কিছু সুপারিশ ভবিষ্যতে কার্যকারিতা ও প্রশাসনিক সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে : অ্যাটর্নি জেনারেল
‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ এর খসড়া বিষয়ক এক সেমিনারে বিশিষ্টজনরা বলেছেন, গত ৫৫ বছর আমরা যে দুঃশাসন, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ,ব্যাংক থেকে সাধারণ মানুষের আমানতের টাকা লুট হচ্ছে দেখলাম এ ধরনের একটি ভয়াবহ ও আত্মবিধ্বংসী রাষ্ট্র কাঠামো থেকে আমাদের এ জাতির ‘সেফ এক্সিট’-এর প্রয়োজন আছে।
গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের বলরুমে অনুষ্ঠিত সেমিনার প্রধান অতিথি ছিলেন আইন উপদেষ্টা ড.আসিফ নজরুল । আইন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সেমিনারে শিল্প, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান,পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব ড. হাফিজ আহমেদ চৌধুরী,বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত রেতো সিগফ্রেড রেংগলি, ড্যানিশ দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন এন্ডার্স বি. কার্লসেন,ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (ইউএনডিপি) রেসিডেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ স্টেফান লিলার। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ইউএনডিপি বাংলাদেশের আইন, বিচার এবং নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা রোমানা শোয়েগার।
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমরা উপদেষ্টারা খুব নিশ্চিতভাবে জানি আমাদের কারো কোনো ‘সেফ এক্সিট’-এর প্রয়োজন নেই, বরং জাতি হিসেবে দেশের মানুষের বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের সৃষ্ট বিধ্বংসী রাষ্ট্র কাঠামো থেকে ‘সেফ এক্সিট’-এর প্রয়োজন।
তিনি বলেন, গত ৫৫ বছর আমরা যে দুঃশাসন, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড দেখলাম, দেখলাম ব্যাংক থেকে সাধারণ মানুষের আমানতের টাকা লুট হচ্ছে- এ ধরনের একটি ভয়াবহ ও আত্মবিধ্বংসী রাষ্ট্র কাঠামো থেকে আমাদের এ জাতির ‘সেফ এক্সিট’-এর প্রয়োজন ।
আসিফ নজরুল বলেন, বাহাত্তরের সংবিধানে বলা হয়েছিল যে রাষ্ট্রপতি বিচারপতিকে স্বাধীনভাবে নিয়োগ করবেন যেন এতে রাজনৈতিক প্রভাব না থাকে। কিন্তু সবাই জানেন রাষ্ট্রপতি কখনই স্বাধীনভাবে বিচারপতিকে নিয়োগ করতে পারেননি। এদেশে সবসময় বিচারপতি নিয়োগ পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা অনুযায়ী।
আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা এমন প্রধান বিচারপতিও পেয়েছি যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ও গণতন্ত্র ধ্বংস করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন। যারা নিজের চোখে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড দেখেও তা উপেক্ষা করেছেন। যেসব বিচারক মানবাধিকার লঙ্ঘনে ভূমিকা পালন করেছে তাদের শাস্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘দুঃখজনকভাবে এমন কেউ কেউ এখনো বিচার বিভাগে রয়ে গেছে। আমরা ইনস্টিটিউশনাল রিফর্মের পথে কিছুটা অগ্রসর হয়েছি, পুরোটা করতে পারি নাই।পরে যারা নির্বাচিত সরকার আসবেন, তাদের ও সময় এই দায়িত্বটা থাকল।’
আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা হয়তো ভালো ভালো কিছু আইন করে যাচ্ছি। কিন্তু ভালো আইন করা মানেই পুরো দেশটা বদলে যাবে সেরকম নয়। দেখা গেছে অনেক ভালো ভালো আইন করা হলেও সে আইন যে প্রতিষ্ঠানের জন্য করা হয়েছে সে প্রতিষ্ঠানই দাঁড়ায় না। আইন করার ক্ষেত্রে আমাদের কোনো ব্যর্থতার ইতিহাস নেই। কিন্তু প্রতিষ্ঠান করার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা সীমাহীন।’
তিনি বলেন, এখন সেফ এক্সিট নিয়ে কথা হচ্ছে। আমরা উপদেষ্টারা নিশ্চিতভাবে জানি, আমাদের কারও কোনো সেফ এক্সিটের প্রয়োজন নেই। জাতি হিসেবে সেফ এক্সিটের প্রয়োজন রয়েছে। বিগত ১৬ বছর দুঃশাসন, গুম-খুন ও লুটপাট দেখলাম। অসুস্থ, ভয়াবহ, আত্মবিধ্বংসী কাঠামো থেকে আমাদের অবশ্যই সেফ এক্সিটের দরকার রয়েছে।
তিনি বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ এর খসড়া বিষয়ক জুলাই গণ অভ্যুত্থানকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকান্ড’ বলায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একজন পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
তিনি,বলেন ‘আমাদের দেশে সেনাসমর্থিত সময় একটা জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়। যেটা এরপরে রাজনৈতিক কর্মীদের দ্বারা সজ্জিত করা হয়েছিল এবং মানুষের অধিকারকে অধিকারহীন করে দেওয়ার জন্য তৎপরতা ছিল তাদের। এমনকি যখন জুলাই ৩৬ এর সংগ্রাম চলছে, তখন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একজন ডাইরেক্টর জাতিসংঘে চিঠি লেখেন যে সন্ত্রাসবাদীরা বাংলাদেশে সন্ত্রাস তৈরি করছে। এই ব্যাপারে কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমি আশা করব মানবাধিকার কমিশনের এই ব্যক্তিদের ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয় থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
নতুন অধ্যাদেশের অধীনে ‘সত্যিকারের’ মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশে গড়ে উঠবে বলে আশা প্রকাশ করে মানবাধিকারকর্মী আদিলুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘এশিয়ার বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার কমিশন আছে। সব কটি কার্যকর হয়নি। বাংলাদেশে এখন কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই আইনের খসড়া সত্যিকার অর্থে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডসহ বিভিন্ন ধরনের যে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়ে থাকে, সেগুলো দেখবে। আদালত যেন তৈরি থাকে। যা আগে ছিল না।’
তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা রয়েছে। তার আগেই এই কাজ শেষ করার ওপর জোর দিয়ে শিল্প উপদেষ্টা বলেন, ‘যাতে বাংলাদেশের মানুষ আর কখনো অন্যায় অবিচারের শিকার না হয় বা শিকার হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি না হয়।’
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, পরিবেশ মানবাধিকার রক্ষাকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের নিরাপত্তাকে আইনগত কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে।
তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে পরিবেশ মানবাধিকার রক্ষাকারীরা হত্যা ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, যা জাতিসংঘও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। বাংলাদেশের জাতীয় আইনেও এ বিষয়টির প্রতিফলন থাকা জরুরি।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, মানবাধিকার রক্ষায় বিচার বিভাগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আদালত অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। বর্তমান খসড়া অধ্যাদেশটি সামগ্রিকভাবে ভালো এতে তদন্ত, সুপারিশ, ক্ষতিপূরণ, প্রশিক্ষণ, পরামর্শ, সালিশ ও মধ্যস্থতা—সব উপাদান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো কমিশনকে কীভাবে কার্যকর ও সক্ষম করা যায়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে আরেকটু শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, এ আইনের বিভিন্ন ধারা ও উপধারায় অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। যা ভবিষ্যতে কার্যকারিতা ও প্রশাসনিক সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে। তাই কমিশনকে আরও কার্যকর বা স্বাধীন হতে হবে।
কমিশনের নানান দিক তুলে ধরে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, একটি গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কিন্তু অ্যাকশন নেওয়ার যে মেকানিজমগুলো আছে, তা গুরুত্ব দিয়ে করার জন্য বা সরাসরি মামলা করতে পারবেন; সে ধরনের কোনো পদক্ষেপ বা বিধান আইনে রাখা হয়নি।