জুলাই-গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির রায়ের তারিখ ঘোষণা করা হতে পারে আজ বৃহস্পতিবার। এ রায়কে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজধানী ঢাকায় ‘লকডাউন’ কর্মসূচি দিয়েছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ। এ কর্মসূচিকে ঘিরে রাজধানীসহ সারাদেশে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সম্ভাব্য নাশকতা প্রতিরোধে শুরু হয়েছে সাঁড়াশি অভিযান, বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল কার্যক্রম। মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ১৭ হাজার পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।

তবে পুলিশ বলছে, আতঙ্কের কিছু নেই। যারাই অপরাধমূলক কর্মকা- চালাবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এদিকে গতকালও রাজধানীর কয়েকটি স্থানে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে দুর্বৃত্তরা। রমনা থানার সামনে পুলিশের একটি গাড়িতেও অগ্নি সংযোগ করা হয়। ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ দিনে রাজধানীর ১৫ স্থানে ১৭টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার ও সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় রাজধানী ঢাকা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলায় ১৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বাসসকে এ তথ্য জানিয়েছেন। একই সঙ্গে ঢাকার প্রবেশপথ ও বিভিন্ন মোড়ে চেকপোস্ট বসিয়েছে পুলিশ। মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনে তল্লাশি চালানো হচ্ছে, যাচাই করা হচ্ছে কাগজপত্র। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জানিয়েছে, মঙ্গলবার রাতের অভিযানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ৪৪ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগ পৃথক অভিযান চালিয়ে আরও কয়েকজনকে আটক করেছে। এছাড়া মঙ্গলবার রাতেই বঙ্গবন্ধু অ্যাভেনিউ, ফকিরাপুল, কাকরাইল, এলিফ্যান্ট রোডসহ বিভিন্ন এলাকার আবাসিক হোটেলগুলোতে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। অতিথিদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পেশা যাচাই করা হয়েছে, ঢাকায় আসার কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। কেউ আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত কি না তা যাচাই করতে মোবাইল ফোনও তল্লাশি করা হয়।

রমনা বিভাগের ডিসি মাসুদ আলম জানান, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই আমরা হোটেল ও মেসে অভিযান চালাচ্ছি। কলাবাগানের একটি মেস থেকে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যারা নাশকতার পরিকল্পনায় ঢাকায় এসেছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। পুলিশ জানায়, সন্দেহভাজন কাউকে আটক করার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ ও তথ্য যাচাই করা হয়। কারও বিরুদ্ধে মামলা বা অভিযোগ থাকলে তা পুলিশের সিডিএমএস ডাটাবেজ থেকে মিলিয়ে দেখা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আগের মামলা পাওয়া গেছে। বিজিবির এক কর্মকর্তা জানান, বৃহস্পতিবারের ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে কোনো ধরনের নাশকতা রোধে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। কেউ নাশকতা করার চেষ্টা করলে তা কঠোরভাবে দমন করা হবে বলেও সতর্ক করেছেন তিনি।

পুলিশ জানায়, গত কয়েক দিনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ঢাকায় অবস্থিত রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে, ডিএমপির ৫০টি থানায় অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র অনুযায়ী, পুলিশ পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে থাকার দাবি করলেও কার্যত মাঠপর্যায়ে এর প্রভাব পুরোপুরি লক্ষ্য করা যায়নি। গত কয়েক দিনে দুর্বৃত্তরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যানবাহন থেকে শুরু করে বিভিন্ন যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়েছে। এছাড়া, মুখোশ ও হেলমেট পরিধানকারী একদল লোক রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নির্বিচারে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। দুর্বৃত্তরা শুধু ককটেল বিস্ফোরণ বা বাসে আগুন দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না, তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করছে।

রমনা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গোলাম ফারুক বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় গত কয়েক দিন ধরে রমনা থানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। শুধু থানায় নয়, রমনা থানার অধীনে যেসব এলাকা আছে, সেসব এলাকায়ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। ডিএমপির শাহবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খালিদ মনসুর বলেন, থানার সামনে বাড়তি পুলিশ সদস্য মোতায়েনের বিষয়টি স্বাভাবিক নিরাপত্তা কার্যক্রম। এছাড়া, শাহবাগ থানা এলাকায় প্রায়ই দাবি-দাওয়া নিয়ে বিভিন্ন আন্দোলন সংঘটিত হয়। এসব বিষয় এবং বর্তমান পরিস্থিতি মাথায় রেখে বাড়তি পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তবে, বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। গতকাল বুধবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিক সম্মেলনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি প্রধান) শফিকুল ইসলাম বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা বিভিন্ন উসকানি ও নির্দেশনা দিচ্ছে, তাদের বিষয়ে ডিবি সতর্ক রয়েছে। আমরা দেখছি, সোশ্যাল মিডিয়াতে বিভিন্ন উসকানি ও নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে তবে রাজপথে তাদের দেখা যায় না। এমনকি একজন নিরীহ রিকশাওয়ালাকে ৫০০ টাকা দিয়ে স্লোগান দিতে বলা হয়েছে, পরে সেই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ওই রিকশাচালকের কোনো অপরাধমূলক রেকর্ড নেই। এভাবে সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করে বিভ্রান্তি তৈরি করার চেষ্টা চলছে, যা ডিবি কঠোরভাবে দমন করছে। তিনি বলেন, আইনের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করে এ ধরনের অপতৎপরতা দমন করা হবে। নাগরিকদের অনুরোধ করছি, গুজবে কান না দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহযোগিতা করুন

এর আগে মঙ্গলবার বিকেলে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সংক্রান্ত সাংবাদিক সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ঢাকাবাসীর আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ১৩ নভেম্বর নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে, তা ভিত্তিহীন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা প্রস্তুত আছি। ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের তুলনায় অনেক ভালো। নিষিদ্ধ দলের সম্ভাব্য নাশকতার আশঙ্কা প্রসঙ্গে কমিশনার বলেন, এক-দুটি মোটরসাইকেল থেকে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে, তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এসব ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের কাজ চলছে। ঢাকাবাসী আমাদের সঙ্গে আছে। তাই কোনো অঘটন ঘটলে তা মোকাবিলার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে।

সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি কম: জানা গেছে, গত দুদিন গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও চোরাগোপ্তা ককটেল বিস্ফোরণে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। যদিও এসব নাশকতা ঠেকাতে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। তবে এ অবস্থায় অনেকে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বের হওয়া এড়িয়ে চলছেন। তবে অনেকটা স্বাভাবিক রয়েছে মোটরসাইকেল, রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল। অন্য সময়ের মতো ভিআইপি সড়কে আজও রিকশা চলাচল করতে দেখা গেছে। সড়কে বাস চলাচলও স্বাভাবিক। গতকাল বুধবার রাজধানীর মিরপুর, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, মিন্টো রোড ও হাতিরঝিল এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। এসব এলাকায় গত কয়েকদিনের তুলনায় আজ প্রাইভেটকারের চলাচল তুলনামূলক কম। সড়কে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, যানবাহনে আগুন ও বিভিন্ন এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় ব্যক্তিগত গাড়ি কম বের হয়েছে। রাজধানীর লালবাগ, আজিমপুর, নিউমার্কেট ও ধানমন্ডি এলাকায় তুলনামূলক গাড়ির সংখ্যা কম দেখা গেছে। তবে নিউমার্কেট খোলা থাকায় মার্কেটের সামনের সড়কে কিছু গাড়ির জটলা দেখা গেছে। বাড্ডা লিংক রোডে বেশ কিছু রিকশা ও মোটরসাইকেলকে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। সেখানে কথা হয় মুসা মল্লিক নামের এক মোটরসাইকেল চালকের সঙ্গে। ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালান মুসা। তিনি বলেন, অনেকে নিজের গাড়ি রেখে গণপরিবহনে চলাচল করছেন। রাস্তাঘাটে লোকজনও কম মনে হচ্ছে। দুপুরে মহাখালী, গুলশান, বাড্ডা ও রামপুরা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ তেমন নেই। তল্লাশি কার্যক্রমও চলছে এসব এলাকায়। তবে অনেকেই মোটরসাইকেলে ভাড়ায় রাইড শেয়ার করছেন। ভাড়ায় চলছে সিএনজিচালিত অটোরিকশাও। বিজয় নামের একজন সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক বলেন, আজ যানজট কম। লোকজন কম সবখানে। মানুষ আতঙ্কে আছে। জরুরি প্রয়োজন না হলে খুব একটা বের হচ্ছে না। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, যারা ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি বা অপতৎপরতার চেষ্টা করছে, আইনের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাদের দমন করা হবে। তিনি বলেন, আমরা রাজধানীতে নাশকতামূলক কর্মকা- পরিচালনাকারীদের পাশাপাশি তাদের নেপথ্যে যারা রয়েছে, তাদেরও গ্রেফতার করছি। আজকেও (বুধবার) ৪৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

রেলওয়ের নিরাপত্তা : সাম্প্রতিক বিভিন্ন অগ্নিকান্ডের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রেলওয়ের সব স্টেশন, ট্রেন ও স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। গতকাল বুধবার রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ফাতেমা-তুজ-জোহরা স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ নির্দেশনা জারি করা হয়। আদেশে বলা হয়েছে, দেশে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত কিছু অগ্নিকা-ের মতো দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে রেললাইন, রেলসেতু, রেলওয়ে স্টেশন ও ট্রেনসহ সব স্থাপনায় দুষ্কৃতিকারীদের সম্ভাব্য নাশকতা প্রতিরোধে বাড়তি সতর্কতা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ রেলওয়ের সব স্থাপনায় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী, রেলওয়ে পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার ও তা বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে রেল অবকাঠামো ও চলন্ত ট্রেনকে লক্ষ্য করে নাশকতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এজন্য সর্বস্তরে নিরাপত্তা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।