মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন দেশের প্রথিতযশা আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। তিন দফায় নামাযে জানাযা শেষে তাকে ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

গতকাল সোমবার বেলা ১১টার দিকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সামনের বাগান চত্বরে তার দ্বিতীয় জানাযা হয়। এতে ইমামতি করেন আবদুর রাজ্জাকের বড় ছেলে ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিকী। জানাযায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ও আইনজীবীসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। তৃতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হয় বাদ যোহর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে। সেখানে ইমামতি করেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মা’ছুম। এর আগে রোববার রাত সাড়ে ৮টায় ধানমন্ডির তাক্বওয়া মসজিদে প্রথম নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইমামতি করেন আবদুর রাজ্জাকের বড় ছেলে ব্যারিস্টার ইমরান এ সিদ্দিকী।

গতকাল সোমবার বেলা ১১টার দিকে সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে নামাযে জানাযায় অংশ গ্রহণ করেন জানাযায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান, হাইকোর্ট বিভাগের বেশ কয়েকজন বিচারপতি, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার মো. মাহফুজুর রহমান মিলন, ডিএজি সাইফুর রহমান, এডভোকেট শিশির মনির, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রুহুল কুদ্দুস কাজল, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল, জামায়াতের সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরী, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আমীর নুরুল ইসলাম বুলবুল, এডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন, এডভোকেট এসএম কামাল উদ্দিন, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জুসহ সহস্রাধিক আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। জানাযা শেষে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিসহ অন্যান্য সংগঠন তার লাশে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।

জানাযায় আব্দুর রাজ্জাকের সহকর্মীরা তার বর্ণিল কর্মময় জীবনীর উপর আলোচনা করেন এবং রুহের মাগফেরাত কামনা করেন।

জানাযা শেষে ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিবাদী ছিলেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। যার কারণে বিগত সরকারের আমলে তাকে রোষাণলে পড়তে হয়েছিল। রাজনৈতিক কারণে তিনি প্রবাসে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। তার থেকে জানার অনেক কিছু ছিল। তার মৃত্যু আইন জগতে অনেক শূন্যতা সৃষ্টি করবে।

ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, গত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়ে দীর্ঘদিন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাককে প্রবাসে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে জাতি তার আইনি সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তিনি ছিলেন আইনের দিকপাল।

এর পর তৃতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হয় বাদ জোহর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম মসজিদে। এখানে ইমামতি করেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি মাওলানা এটিএম মা’ছুম।

জানাযা পূর্ব স্মৃতিচারণামূক বক্তব্যে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, দুনিয়ার জন্য ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন একজন সফল মানুষ। অত্যন্ত প্রাজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে ছোটবেলা থেকেই তিনি ইসলামের অনুসারী ছিলেন।

তিনি বলেন, এই বিশ্বাস ও আমল তিনি ব্যক্তি পারিবারিক জীবনে বাস্তবায়ন করে গেছেন। স্বচ্ছ জ্ঞানী এই মানুষটির কুরআনের ওপরে দখল ও পাণ্ডিত্য ছিল।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের।

ক্রন্দন কণ্ঠে তাহের বলেন, আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে দোয়া করি, তাকে যেন জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ স্থান দান করেন। তিনি অত্যন্ত উদার, অমায়িক, আদর্শ অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার জন্য সবাই দোয়া করবেন। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানাচ্ছি।

জানাযাপূর্ব বক্তব্যে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের বড় ছেলে ব্যারিস্টার এহসান আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন, বিচার ও রাজনৈতিক অঙ্গনে তার অবাধ বিচরণ ছিলেন। বাবা সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ছিলেন। তিনি দীর্ঘ ১১ বছর দেশে ছিলেন না, গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর তিনি দেশে আসেন। অসুস্থ স্বত্বেও তিনি কোর্টে আসতেন। ওনার কথাবার্তা ও ব্যবহারে যদি কেউ কষ্ট পেয়ে থাকেন তাহলে ক্ষমা করে দেবেন। আর কেউ যদি দেনাপাওনা থাকে তাহলে বলবেন পরিশোধ করে দেবো।

নামাযে জানাযায় অংশ গ্রহণ করেন, জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য আব্দুর রব, মোবারক হোসাইন, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ জামায়াতের আমীর নূরুল ইসলাম বুলবুল, সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদ, এডভোকেট শিশির মনির, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আব্দুল কাদের বাচ্চু, মাওলানা খলিলুর রহমান মাদানীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন পেশাজীবী ব্যক্তিবর্গ।

এর আগে রোববার বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে যান।

১৯৪৪ সালে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার মাথিউরা ইউনিয়নের শেখলাল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। বিএ (অনার্স) ও এম এ ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৮০ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের লিংকনস ইন থেকে ব্যারিস্টার ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৫ সালের নবেম্বর পর্যন্ত তিনি লন্ডনেই আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।

এরপর ১৯৮৬ সালে দেশে ফিরে আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন তিনি। ১৯৮৮ সালে হাইকোর্ট বিভাগে এবং ১৯৯৪ সালে আপিল বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হন বরেণ্য এই আইনজীবী। তিনি ১৯৯০ সালে দ্য ল’ কাউন্সেল নামে একটি আইনি ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০২ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিনিয়র আইনজীবী হন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।

ব্যারিস্টার রাজ্জাক আলোচিত একুশে টিভি মামলা, ইত্তেফাকের মামলা, অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলা, আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সংসদ সদস্য পদ সংক্রান্ত মামলা, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ নিয়ে মামলা ও ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এছাড়া আবদুল কাদের মোল্লা, অধ্যাপক গোলাম আযম ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের পক্ষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনা করেন। তিনি বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেলের উপদেষ্টাও ছিলেন। রয়েছে তার বিভিন্ন প্রকাশনা।

গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর দেশে ফিরে বিমানবন্দরে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি একজন আইনজীবী। আমি কোর্ট রুম ব্যারিস্টার। আমি আইনের অঙ্গনে আমার অবদান রাখার চেষ্টা করব। আইনের শাসন একটি অতি বড় জিনিস। দেশে যদি আমরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। তাহলে আমাদের রাজনীতি সফল হবে। অর্থনৈতিক উন্নতি হবে। সুতরাং আইন অঙ্গনে আমার বিচরণ, আইন অঙ্গনে আমি থাকব। আইন অঙ্গনের মাধ্যমে আমি দেশ এবং জাতির খেদমত করার চেষ্টা করব। ’

এরপর সম্প্রতি অসুস্থ হয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন।