# আদালতে ছাত্রদল নেতা রবিনের স্বীকারোক্তি

# মাসে ২ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে হত্যাকান্ড, দাবি পরিবারের

# সভ্য দেশে এমন ঘটনা কখনোই কাম্য নয়: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

রাজধানীর মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে (৩৯) প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে মাথায় পাথর দিয়ে থেঁতলে হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। ঘটনার পর প্রতিবাদের ঝড় বইছে। ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে সারা দেশ। সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে গতকাল শনিবারও বিক্ষোভ করেছেন ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এর আগে শুক্রবার রাতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ঢাকা কলেজ ও ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন। এছাড়া চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, বরিশালসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। শিক্ষার্থীরা তাদের বক্তব্যে এ ধরনের বর্বরোচিত হত্যাকান্ডকে ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। দ্রুত খুনিদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেয়া হলে তারা বড় আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

এদিকে মাসে দুই লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে সোহাগকে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি পরিবারের। স্বজনদের অভিযোগ-ব্যবসায়ীক বিরোধ ও চাঁদার টাকার জন্যই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাকে। এই ঘটনায় পুলিশ ও র‌্যাব এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এরমধ্যে ছাত্রদল নেতা তারেক রহমান রবিন গতকাল শনিবার আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। টিটন গাজী নামে আরেকজনকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। গতকাল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, হত্যার ঘটনায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশ বলছে-ব্যবসায়ীক বিরোধে সোহাগকে হত্যা করা হয়েছে। পুুলিশের পাশাপাশি এ ঘটনার ছায়া তদন্ত করছে র‌্যাব।

পৈশাচিক কায়দায় হত্যার শিকার লাল চাঁদ ওরফে সোহাগের নানা বাড়ি বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামে। শুক্রবার সকালে নানাবাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুতে এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। এখনো চলছে স্বজনদের আহাজারি। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, সাত মাস বয়সে বজ্রপাতে সোহাগের বাবা আইউব আলী মারা যান। এরপর তার মা আলেয়া বেগম জীবিকার তাগিদে সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় থেকেই সোহাগ বড় হয়েছেন এবং মেসার্স সোহানা মেটাল নামের একটি দোকান পরিচালনা করতেন পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায়। দীর্ঘদিন ধরে দোকান থেকে প্রতি মাসে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করছিল একটি সন্ত্রাসী চক্র। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় বুধবার বিকেলে সোহাগকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখে তারা। এতেও চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে সোহাগকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে পাথর মেরে হত্যা করা হয় বলে জানান স্বজনরা। এ ঘটনায় মামলা দায়ের হলেও সোহাগের স্বজনদের অভিযোগ, পুলিশ জড়িতদের বাঁচাতে কারসাজি করছে। তারা জানান, প্রকৃত অপরাধীদের বাদ দিয়ে মামলায় নিরীহদের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

নিহতের স্ত্রী লাকি বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার স্বামীর ব্যবসা সহ্য হচ্ছিল না ওদের। দীর্ঘদিন ধরেই আমার স্বামীর দোকান থেকে চাঁদা দাবি করে আসছিল হত্যাকারীরা। তারা প্রতি মাসে দুই লাখ করে টাকা চাইছিল। আমার স্বামী তা দিতে চায়নি। শেষমেশ আমার স্বামীকে মেরেই ফেলল। স্বজনেরা বলেন, তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এখনো হত্যাকারীদের লোকজন মোবাইলে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। লাল চাঁদের ১০ বছর বয়সী ছেলে সোহান ও ১৪ বছর বয়সী মেয়ে সোহানা। স্ত্রী লাকি বেগম (৩০) জানেন না, কীভাবে বিদ্যালয়পড়ুয়া এই দুই সন্তানকে সান্ত্বনা দেবেন। নিহত লাল চাঁদ স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে ঢাকার জিঞ্জিরার কদমতলী এলাকায় কেরানীগঞ্জ মডেল টাউনে বসবাস করতেন।

ছাত্রদল নেতা রবিনের স্বীকারোক্তি: ব্যবসায়ী রবিনকে পাথর দিয়ে মাথায় আঘাত করে হত্যার ঘটনায় করা অস্ত্র মামলায় ছাত্রদল নেতা তারেক রহমান রবিন আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছেন। গতকাল শনিবারবিকেলে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হাসিব উল্লাহ গিয়াসের আদালতে স্বেচ্ছায় এ জবানবন্দীদেন তিনি। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। জানা যায়, আসামি তারেক রহমান রবিন রাজধানীর চকবাজার থানার ৩০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক। এর আগে বৃহস্পতিবার রবিনের দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুয়েল রানা। রিমান্ড শেষে আদালতে হাজির করা হলে স্বেচ্ছায় জবানবন্দীদেন রবিন। জানা যায়, ভাঙারি ব্যবসায়ীকে হত্যার ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় দুটি মামলা হয়। একটি হত্যা অন্যটি অস্ত্র মামলা। এরমধ্যে হত্যা মামলায় মাহমুদুল হাসান মহিনকে পাঁচদিন এবং তারেক রহমান রবিনকে অস্ত্র মামলায় দুদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের পাঁচজনকে বহিষ্কারের কথা জানিয়েছে বিএনপি।

পুলিশ ও স্থানীয়রা বলছেন, ওই হত্যাকাণ্ডে যাদের অংশ নিতে দেখা গেছে, এবং নেপথ্যে যাদের নাম আসছে, তারা সবাই পূর্ব পরিচিত এবং একই দলের লোক। একসময় তাদের কয়েকজন সোহাগের ব্যবসার সহযোগী ছিলেন। ব্যবসা সংক্রান্ত বিরোধে এমন ভয়ঙ্করভাবে কাউকে হত্যা করা হতে পারে, তা পরিচিতজনদের ধারণারও বাইরে। ওই এলাকার একজন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ব্যবসায়ী বলছেন, পুরনো তারের ব্যবসার একটি বড় সিন্ডিকেট সেখানে রয়েছে, যার নিয়ন্ত্রণ করতেন সোহাগ। গ্রেপ্তার মহিন তার দলবল নিয়ে ওই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। সেই চেষ্টায় তারা সোহাগের গোডাউনে তালা মেরে দেয়। তাদের মধ্যে এটা নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক হয়। জড়িতদের কয়েকজন স্থানীয় যুবদলের রাজনীতিতে জড়িত। সোহাগও এক সময় যুবদল করতেন।

সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে: মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ভাঙারি পণ্যের ব্যবসায়ী সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। শনিবার পুরান ঢাকার মিল ব্যারাকে রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স ও ঢাকা জেলা পুলিশ লাইন্স পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এই ঘটনাটা বড়ই দুঃখজনক। একটা সভ্য দেশে এমন একটি ঘটনা কখনোই আশা করা যায় না। এটার জন্য যারা দায়ী, তাদের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগেও অস্ত্রসহ দুজনকে র‌্যাব ধরেছে। মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছেও দুজন ধরা পড়েছে। এছাড়া ডিবির টিম কাজ করছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। উপদেষ্টা বলেন, আমরা খুব অসহিষ্ণু হয়ে গেছি। এই অসহিষ্ণুতা আমাদের কমিয়ে আনতে হবে। সমাজের নীতি-নির্ধারক, অভিভাবক, শিক্ষক, চিকিৎসক সবার চেষ্টায় এই সহিংসতা কমিয়ে আনতে হবে। তিনি বলেন, আমরা সবাইকে অনুরোধ করছি, কেউ যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়। কোনো ঘটনা ঘটলে সেটা যেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জানানো হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সেটার যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। অনেকে অভিযোগ করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো কঠোর হচ্ছে না। এমন অভিযোগ সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর না হলে পাঁচজনকে কীভাবে গ্রেপ্তার করা হলো?

ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে খুন হয় সোহাগ, পুলিশ: ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নতুন তথ্য দিয়েছে পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীটি জানিয়েছে, চাঁদাবাজি নয়, একটি দোকানে কারা ব্যবসা করবে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। হত্যাকাণ্ডের শিকার সোহাগ এবং হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে তাদের একসঙ্গে ব্যবসাও ছিল। শনিবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিক সম্মেলনে এসব কথা জানান লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন। গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে তিনি বলেন, ভাঙারি ব্যবসা এবং দোকানে কারা ব্যবসা করবে সেটা নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব চলছিল। হত্যাকাণ্ডের শিকার সোহাগ এবং যারা হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছেন তারা সম্পর্কিত। তারা একসঙ্গে কিছুদিন ব্যবসা করেছেন। যখন ব্যবসার লেনদেন নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় তখনই তারা বিবাদে লিপ্ত হন। এর ফলে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লালবাগ বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ জসীম বলেন, বুধবার বিকেল ৬টার দিকে রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিন নম্বর গেটের সামনে একদল লোক লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ নামের এক ব্যক্তিকে এলোপাতাড়িভাবে আঘাত করে ও কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ঘটনার সংবাদ পাওয়ার পর কোতোয়ালি থানা পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে যায় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরবর্তীতে ১০ জুলাই এ ঘটনায় নিহতের বড় বোন বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে পুলিশ নিহতের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করে এবং ময়নাতদন্তের জন্য তা হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। পুলিশ ১১ জুলাই ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে এবং রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে এজাহারভুক্ত আসামি মাহমুদুল হাসান মহিন (৪১) ও তারেক রহমান রবিনকে (২২) গ্রেফতার করা হয়। এ সময় গ্রেফতার তারেক রহমান রবিনের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে র‌্যাব কর্তৃক আলমগীর (২৮) ও মনির ওরফে ছোট মনির (২৫) নামের আরও দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া, শুক্রবার রাতে মো. টিটন গাজী (৩২) নামে আরও এক এজাহারভুক্ত আসামিকে গ্রেফতার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। লালবাগ বিভাগের ডিসি আরও বলেন, এ ঘটনায় পুলিশ অত্যন্ত তৎপর। এই চাঞ্চল্যকর ঘটনায় মূল রহস্য উৎঘাটন, সংশ্লিষ্ট সব অপরাধী গ্রেফতার এবং সোহাগ কেন এই ঘটনার শিকার হলো তা উৎঘাটনের জন্য একটি চৌকস টিম গঠন করা হয়েছে। ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদের গ্রেফতারে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

ছায়া তদন্ত করছে র‌্যাব, ডিজি: ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ হত্যার ঘটনায় র‌্যাব ছায়া তদন্ত করছে বলে জানিয়েছেন বাহিনীটির মহাপরিচালক (ডিজি) একেএম শহিদুর রহমান। গতকাল কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা জানান। সোহাগ হত্যার ঘটনায় এরই মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের মধ্যে এজাহারভুক্ত দুই আসামিকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। তিনি বলেন, ছায়া তদন্তের মাধ্যমে আমরা ডিএমপিকে সহায়তা করছি। আমরা আমাদের ছায়া তদন্ত গোপনে চালিয়ে যাচ্ছি।