জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের ১৮তম দিনের আলোচনায় নির্বাচন কমিশনের প্রধান এবং অন্যান্য কমিশনারদের নিয়োগ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল বুধবার দুপুরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দিনব্যাপী আলোচনা শেষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা জানান।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনারের নিয়োগের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিদ্যমান সংবিধানের ১১৮ (১) সংশোধন করে নতুন সংশোধিত প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে। সংশোধিত প্রস্তাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং আইনে নির্ধারিত সংখ্যক নির্বাচন কমিশনার সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন কমিশন থাকবে।
তিনি আরও বলেন, স্পিকারের নেতৃত্বে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি বাছাই কমিটি গঠিত হবে। এই কমিটি বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের প্রধান এবং অন্যান্য কমিশনারগণের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন পূর্বে পরবর্তী ৫ বছরের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য কমিশনারগণকে নিয়োগ করার উদ্দেশ্যে সংসদে প্রণীত আইনের দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে ‘ইচ্ছাপত্র’ ও প্রার্থীর সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি আহ্বান করাসহ নিজস্ব উদ্যোগে উপযুক্ত প্রার্থী অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
কমিশনের সহ-সভাপতি বলেন, স্পিকারের নেতৃত্বে বাছাই কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হবেন বিরোধী দলীয় ডেপুটি স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা ও প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধি হিসেবে আপীল বিভাগের একজন বিচারপতি।
তিনি জানান, এই কমিটি আইনের দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে অনুসন্ধানে প্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের জীবনবৃত্তান্তসমূহ স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই করে, সর্বসম্মতিক্রমে তাদের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্ধারিত প্রতিটি পদের বিপরীতে একজন করে নির্বাচন কমিশনার হিসাবে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট প্রেরণ করবেন এবং রাষ্ট্রপতি তাদেরকে কার্যভার গ্রহণের তারিখ হতে পরবর্তী ৫ বছরের জন্য নিয়োগ দান করবেন।
এ সময় তিনি আরও জানান যে, স্পিকারের তত্ত্বাবধানে জাতীয় সংসদ সচিবালয় এই কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবে। বিদায়ী কমিশনের মেয়াদ শেষ হলে অথবা অন্য কোনো কারণে পদ শূণ্য হলে পরবর্তী দিন হতে নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারগণ দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এ ছাড়া, আজকের আলোচনার পর জাতীয় সংসদ কর্তৃক নির্বাচন কমিশনের ওপর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পৃথক আইন ও আচরণবিধি প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে, বিদ্যমান সংবিধানের উপানুচ্ছেদ ২, ৩, ৪, ৫ ও ৬ অপরিবর্তিত থাকবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আজকের আলোচনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিগণ অংশগ্রহণ করেন।
এ আলোচনায় কমিশনের সদস্য হিসেবে বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. মো. আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, দ্রুত জুলাই সনদ প্রণয়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অমীমাংসিত সকল বিষয়ে ঐকমত্য গড়তে আগামী কিছুদিন কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা চলমান থাকবে।
আলোচনা শেষে নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ সংবিধানে যুক্ত করা নিয়ে দলগুলো ঐকমত্যে এসেছে উল্লেখ করে জামায়াতে ইসলামী নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, কমিশন গঠনের পাশাপাশি কমিশনারদের আচরণবিধি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বিষয়েও ঐকমত্য হয়েছে।
তাহের বলেন, আজকের আলোচনা অত্যন্ত গঠনমূলক ও ইতিবাচক ছিল। অনেক মতপার্থক্য থাকলেও শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই একমত হয়েছি যে নির্বাচন কমিশনকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং এটির গঠন একটি সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে হবে। তিনি জানান, পাঁচ সদস্যের একটি সিলেকশন কমিটি গঠন করা হবে যার সদস্যরা হবেনÑস্পিকার (সভাপতি), বিরোধীদলীয় মনোনীত ডেপুটি স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা এবং প্রধান বিচারপতির মনোনীত একজন আপিল বিভাগের বিচারক। এই কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের মনোনয়ন দিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে এবং রাষ্ট্রপতি সেই নাম অনুযায়ী নিয়োগ দিতে বাধ্য থাকবেন।
তিনি বলেন, এখানে রাষ্ট্রপতির নিজস্ব মতামতের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এই অংশে আমরা একটি গঠনমূলক এবং সম্মানজনক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ নির্বাচন কমিশন গঠনের ভিত্তি তৈরি করতে পেরেছি। তাহের বলেন, আগে নির্বাচন কমিশনের প্রধান ও চারজন কমিশনার থাকলেও নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী সংখ্যাটি আইন দ্বারা নির্ধারিত হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী কমিশনারের সংখ্যা বাড়তেও পারে, কমতেও পারে।
তিনি বলেন, আমরা প্রস্তাব করেছি, সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের পর একটি নতুন ধারা যুক্ত করে আইন প্রণয়ন করতে হবে, যা নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের একাউন্টেবিলিটি ও অপসারণ প্রক্রিয়া নির্ধারণ করবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গে তাহের বলেন, নির্বাচন কমিশন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুইটি আলাদা বডি। তবে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠনের আলোচনাও প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে, সেটিও চূড়ান্ত হলে জানানো হবে। জামায়াত নেতা বলেন, আজকের আলোচনা ছিল ঐক্য ও বিশ্বাসের প্রতীক। “সবাই আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধের সঙ্গে অংশ নিয়েছেন। আমরা আশা করি এই ঐকমত্য আগামী নির্বাচনের জন্য একটি শক্তিশালী সাংবিধানিক ভিত্তি তৈরি করবে। তিনি আরও বলেন, আজকের বৈঠকে নির্বাচন কমিশন নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলেও অন্য সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে পরবর্তী বৈঠকে আলোচনা হবে।