দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ানো জরুরি বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। তারা বলেন, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর জনগণের আস্থার সংকট চরমে। অথচ দেশেই ভালো চিকিৎসা সম্ভব। তারা বলেন, বেসরকারি চিকিৎসা খাতকে সেবামুখী ব্যবসায় পরিণত করতে হবে। তাদেরকে ব্যবসামুখী সেবা থেকে বিরত থাকতে হবে। গতকাল শনিবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে বণিক বার্তা আয়োজিত ‘বাংলাদেশ হেলথ কনক্লেভ-২০২৫’-এ যোগ দিয়ে তারা এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান, বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ানো জরুরি উল্লেখ করে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য অনেককে বিদেশ যেতে হয়। সেখানে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়। অথচ বিষয়টা উল্টো হওয়ার কথা ছিল। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ানো জরুরি।

সম্মেলনে অনলাইনে যুক্ত হন পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, আমাদের দেশে বড় বড় অবকাঠামো আছে, কিন্তু ডাক্তার নেই। ডাক্তার আছে, নার্স নেই। দক্ষ জনবল সংকটে সাধারণ মানুষ মানসম্মত চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না। পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, স্বাস্থ্য খাতে যারা বিনিয়োগ করেন, তারা সাধারণ মানুষের জন্য কমমূল্যের একটি ক্লিনিক তৈরি করতে পারেন। মানসম্মত স্বাস্থ্য খাতের জন্য সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগে সমন্বয় জরুরি।

এ সময় তার বক্তব্যে উঠে আসে, সরকারি অনেক বড় বড় অবকাঠামো পড়ে আছে। সেগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়ে স্বাস্থ্য খাতের আরো উন্নয়ন সম্ভব।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে প্রাইভেট হাসপাতাল, ফার্মাসিউটিক্যাল খাতগুলোকে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে হবে। প্রাইভেট সেক্টরে যে হাসপাতাল, ফার্মাসিটিক্যাল আছে তাদেরকে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে দেন। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সরকারি নিয়ন্ত্রণ। স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ও সংস্কারে প্রাইভেট হাসপাতালগুলোকে সেলফ রেগুলেশনের (স্বনিয়ন্ত্রণের) সুযোগ দিতে হবে।

আমীর খসরু বলেন, বাংলাদেশে প্রাইভেট হাসপাতাল, ফার্মাসিউটিক্যাল খাতগুলোকে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে হবে। বেসরকারি খাতের হাসপাতাল ও ফার্মাসিটিক্যালগুলোকে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে দিন। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সরকারি নিয়ন্ত্রণ। এ দেশ সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রিত। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ডি-রেগুলেটেড করার। অনেকের হয়তো নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু ডি-রেগুলেটেড ও স্বাধীনতা দিতে আমরা এগোচ্ছি। বেসরকারি খাতের যে হাসপাতাল, ক্লিনিক আছে, তাদের স্বনিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দিন। এটি সারা দুনিয়ায় আছে। সরকার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে না। শুধু বাংলাদেশে এমনটি হয়। এখান থেকে বের আসতে হবে। আমাদেরকে স্বনিয়ন্ত্রণের দিকে যেতে হবে। বাংলাদেশে যেখানে যত বেশি নিয়ন্ত্রণ, সেখানে তত বেশি দুর্নীতি। এ নিয়ন্ত্রণ আনা হয় দুর্নীতির জন্য।

স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়াতে হবে বলে মনে করেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে ৬ থেকে ৮ শতাংশ বাজেট দরকার। আমাদের দেশের জনসংখ্যা অনুযায়ী বাজেট নির্ণয় করা হচ্ছে না। আমি মনে করি, এটি প্রাথমিক ও প্রধান একটি ইস্যু যেটাকে সমন্বয় করতে হবে।

তিনি বেসরকারি চিকিৎসা খাতকে সেবামুখী ব্যবসা হতে হবে, ব্যবসামুখী সেবা নয়। এজন্য যথাযথ সেবাও নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া বেসরকারি খাতেও খরচ কমানো সম্ভব। এটি উদ্যোক্তাদের নিশ্চিত করতে হবে।

ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আমার হসপিটাল আছে। সেখানে সিজারিয়ানে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। যিনি অপারেশন করেন তিনি ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা নেন। তিনি যখন চৌদ্দগ্রামে গিয়ে অপারেশন করেন তখন ৩ হাজার টাকা নেন, আবার যখন ঢাকায় আসেন তখন ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা নেন। ডাক্তার তো একজনই।

এ সময় জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমিরের বক্তব্যে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ানো প্রয়োজনীয়তার কথা উঠে আসে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে ৬ থেকে ৮ শতাংশ বাজেট দরকার। আমাদের দেশের জনসংখ্যা অনুযায়ী বাজেট নির্ণয় করা হচ্ছে না। আমি মনে করি, এটি প্রাথমিক ও প্রধান একটি ইস্যু যেটাকে সমন্বয় করতে হবে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ করতে হবে। এটিকে আমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। এটিকে দেশে আরো বেশি বিস্তৃত করতে হবে। বেসরকারি খাতকেই অধিকতর গুরুত্ব দেয়া দরকার। যারা যখন ক্ষমতায় থাকবেন, নীতি বাস্তবায়নে তাদের সিরিয়াস থাকতে হবে।

সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের বিকল্প নেই মন্তব্য করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান বলেন, প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক হাসপাতালের লাইসেন্সের ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। ২০১৭ সাল থেকে অনেক লাইসেন্স পেন্ডিং আছে। কিছু শর্ত দিয়ে চার মাসের মধ্যে তাদের লাইসেন্স দিতে পারি। শর্তপূরণে কিছু সময় বেঁধে দিতে পারি। সব প্রতিষ্ঠান মান উপযোগী না।

তিনি বলেছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে আসলে ১৭ কোটি মানুষের স্বাস্থ্য সেবার পুরোটা নিশ্চিত করা আসলে সম্ভব নয়। আমরা দেখছি, ৭৩ শতাংশ সেবা আসছে সরকারের বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। এখানে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিও আছে। তবে আমাদের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। এ সমন্বয় কীভাবে করা যায় সেটি নিশ্চিত করতে হলে একে অপরকে দোষারোপ না করে ইতিবাচকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এ সেবা নিশ্চিত করতে হলে এক হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

সাইদুর রহমান বলেন, গ্রামের চেয়ে নগরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নাজুক। সেটিকে কীভাবে কার্যকর করা যায়, তার জন্য ঢাকার ২১টি গভর্নমেন্ট ডিসপেনসারিকে (জিওডি) কার্যকর করতে চাচ্ছি। বক্তব্যে আগামী চার মাসের মধ্যে শর্তসাপেক্ষে বেশ কিছু প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স দেয়া হবে বলে জানান স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে নগরভিত্তিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ স্থানীয় সরকারের হাতে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ। তিনি বলেন, দেশে স্বাস্থ্য খাতে প্রতি ১০০ টাকা ব্যয়ের মধ্যে ৭৪ টাকা বহন করতে হয় রোগীকে। এটি বিশ্বে সর্বোচ্চ। কোনো একটি অসুখ হলে সেটা থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পেতে পারি, সেজন্য সরকারি-বেসরকারি একটি সমন্বয় দরকার। সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য খাতে হাজার হাজার কোটি ব্যয় করে। কিন্তু সেটা সঠিক জায়গায় যাচ্ছে কিনা, সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কিনা, তা ভাবতে হবে।

তিনি বলেন, দেশের স্বাস্থ্যখাতে নগরভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা কীভাবে স্থানীয় সরকারের অধীনে থাকে? বিশ্বের কোথায় এমনটা আছে? স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এমন একটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কীভাবে থাকে, যারা স্বাস্থ্য সম্পর্কে কিছুই বোঝে না! এর জন্য প্রথমে প্রয়োজন সরকারের ভেতরের সমন্বয়। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভেতরের যে বিভিন্ন বিভাগ আছে তাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। তিনি আরো বলেন, নগরভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথা চিন্তা করলে হলে প্রথমেই এই ব্যবস্থাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, এখানে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারেত্ব আসা যায় কিনা, সেটাও ভাবতে হবে।

স্বাস্থ্য খাতে বর্তমান অন্তবর্তী সরকার বাজেট বাড়াতে পারেনি। ফলে প্রান্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা ব্যাপকহারে বিঘিœত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো আবু জাফর। নতিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এ খাতে বিভিন্ন সমস্যা বিদ্যমান। এর মধ্যে পলিসিগত দুর্বলতা, বাজেট স্বল্পতা, জনবল ও অবকাঠামোর অভাব রয়েছে বলে অভিমত তার।

ডা. জাফর বলেন, সর্বস্তরে ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার বিকল্প কোনো উপায় নেই। ২০৩০ সালের মধ্যে সকল মানুষের জন্য উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, দেশের প্রান্তিক এলাকায় ডাক্তারের অভাব স্বাস্থ্য সেবাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। হাসপাতালগুলোতে ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি রোগী ও অ্যাটেনডেন্টদের চাপ। ফলে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। যেমন-৫০০ শয্যার হাসপাতালে ২ হাজার রোগী থাকলে ৩ হাজার অ্যাটেনডেন্স থাকেন, যা সেবায় বড় বাঁধা। এছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ওয়াশরুমের মতো মৌলিক সুবিধাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে। বর্তমান সীমাবদ্ধতা ও অপ্রতুলতা নিয়ে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী স্বাস্থ্য সেবা দেয়া সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করেন স্বাস্থ্যের ডিজি।