আসন্ন ত্রয়োদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যদেরকে আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে মাসকেট্রি (অস্ত্র চালানোর কৌশল) অনুশীলন শেষ করার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। একই সাথে অনুশীলন শেষে পুলিশ সদস্যদের তালিকা ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সদর দফতরে পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের আর্মস এন্ড অ্যামুনেশন শাখা থেকে সম্প্রতি মাঠ পর্যায়ের পুলিশকে এই নির্দেশসহ অনুরোধ জানানো হয়। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, ‘থাকবে পুলিশ জনপদে, ভোট দেবেন নিরাপদে’- এই প্রতিপাদ্যে উজ্জীবিত হয়ে বিগত দিনের নির্বাচনী কালিমা মোছনের চেষ্টার অংশ হিসেবে নির্বাচনী দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের মাধ্যমে দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মূল সহযোগিতায় থাকবে পুলিশ। এজন্য নির্বাচনী দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে পুলিশের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত শিরোনামে সাড়ে চারমাসব্যাপী টানা প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করে গত সেপ্টেম্বরে। আগামী জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে এই প্রশিক্ষণ শেষ হবে। এক লাখ ৪৬ হাজার ৬৮৩ জন বিভিন্ন স্তরের পুলিশ সদস্য দেশের জেলা, বিভাগ ও মহানগর পর্যায়ের নির্ধারিত ১৩০ টি কেন্দ্রে ২ হাজার ৯শত ৩৪ টি ব্যাচের মাধ্যমে এই প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছেন। প্রশিক্ষণের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে দেশের সার্বিক আইনশৃংখলা সমুন্নত রাখতে পুলিশী ব্যবস্থায় আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং জনআস্থা বৃদ্ধিকরণে পুলিশের করনীয়’।
পুলিশ সদর দফরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতার অপব্যবহার, অপরাধমূলক অসদাচরণ, জাল-জালিয়াতি, দিনের ভোট রাতে করা এবং আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে চরম বিতর্কিত হয়ে পড়ে পুলিশ বাহিনী। কলঙ্কের দাগ পড়ে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের গায়ে। আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে পুলিশ বাহিনীর সেই কলঙ্ক মুছে দেয়ার নির্বাচন। পুলিশের প্রশিক্ষণকালে এ বিষয়টি বার বার স্মরণ করে দিয়ে নির্বাচনি দায়িত্ব পালনকালে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। এজন্য পুলিশ সদস্যদের আচরণ কেমন হবে. তার গাইডলাইন প্রশিক্ষনে তুলে ধরা হচ্ছে।
পুলিশ সদর দফতরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত ৩টি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে করার ঘটনায় পুলিশকে সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়। এমন প্রশ্নবিদ্ধ কোনো কাজে পুলিশ যেন না জড়ায়, সে বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। সামনে যে নির্বাচনই হোক, পুলিশ সেই নির্বাচনে বিতর্কিত কোনো ভূমিকায় জড়াবে না। বিশেষ নির্বাচনি প্রশিক্ষণে এ বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে স্মরণ করে দেওয়া হচ্ছে মাঠ পুলিশকে।
গত ৩ সেপ্টেম্বর থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে নির্বাচনী বিষয়ে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। সেখানে প্রথমে পুলিশ সুপার (এসপি), অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এডিশনাল এসপি) ও ওসিদের প্রশিক্ষণ দেয় পুলিশ সদর দফতর। তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজ নিজ জেলা ও মেট্রোপলিটন পুলিশের মাঠপর্যায়ের সদস্যদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনছেন। এ ছাড়া বিতর্কমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করতে প্রশিক্ষণ পরিকল্পনায় মক টেস্টের ব্যবস্থাও রাখা হচ্ছে। এই মক টেস্টে ভোটকেন্দ্র, ভোটারদের নিরাপত্তা, ব্যালট বাক্স আনা নেওয়াসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে ধাপে ধাপে পুলিশের কী ধরনের ভূমিকা নিতে হবে তার প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে সদর দফতর‘র তৈরী করা প্রশিক্ষণ মডিউলের মাধ্যমে।
সূত্র জানায়, সারা দেশের নির্ধারিত কেন্দ্রে এই প্রশিক্ষন দিচ্ছেন দুই হাজার ৩৬৫ জন প্রশিক্ষক। গত ৫ অক্টোবর রোববার থেকে চলছে ৪র্থ ও শেষ ধাপের মাঠ পর্যায়ের নির্বাচনি প্রশিক্ষণ। সারাদেশে ১৩০টি ভেন্যুতে কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পর্যন্ত মাঠ পুলিশ সদস্যরা এই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। সুত্র মতে, দেশের ৬৪ জেলা, ৮ টি মেট্রোপলিটন, ২১ টি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), ১৩ টি বিশেষায়িত পুলিশের ইউনিট ও এলিটফোর্স র্যাবের নির্ধারিত ১৩০ টি কেন্দ্রে শুরু হওয়া এই প্রশিক্ষন চলবে জানুয়ারী মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত। প্রতিটি কেন্দ্রে প্রশিক্ষণের জন্য ৫০ জন সদস্য করে এক একটি ব্যাচ করা হয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রের ব্যাচ সংখ্যা ২৮ টি। প্রতিটি ব্যাচের প্রশিক্ষণ চলছে তিন দিন করে। তিন দিনের প্রশিক্ষনের জন্য ১৬ টি সেশনে প্রশিক্ষণ দেবেন প্রশিক্ষকরা। দুটি সেশনে দেখানো হচ্ছে পুলিশের তৈরী করা নির্বাচনী ডক্যুমেন্টরি। এরপর ১০ টি সেশনে দেয়া হচ্ছে একাডেমিক প্রশিক্ষণ। পরবর্তী ৪ টি সেশনে দেয়া হচ্ছে বডিঅর্ণ ক্যামেরা ও অস্ত্রের প্রশিক্ষণ। এর আগে ১৪৬ জন মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করে পুলিশ সদর দফতর। তাদের আবার তৈরী করেছেন ১০ জন লিড ট্রেইনার।
মাসকেট্রি অনুশীলন সম্পন্নের নির্দেশ : পুলিশের চলমান নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের ওপর প্রশিক্ষণ‘র মধ্যেই ধাপে ধাপে চলছে মাসকেট্রি অনুশীলন। এই অনুশীলন শেষে পুলিশ সদস্যদের তালিকা তৈরী করে মাঠ পর্যায় থেকে পুলিশ সদর দফতরে পাঠানোর নির্দেশসহ অনুরোধ জানিয়ে একটি পত্র দেয়া হয়েছে গত ২৯ সেপ্টেম্বর। সহকারী মহা পুলিশ পরিদর্শক (এআইজি) আর্মস এন্ড অ্যামুনিশন শাখা হতে মাঠ পর্যায়ে পাঠানো পত্রে বলা হয়েছে, বিগত এক বছরের মধ্যে মাসকেট্রি অনুশীলন করেন নাই, তাদের তালিকা প্রস্তুতপূর্বক ডিসেম্বর/২৫ এর মধ্যে মাসকেট্রি অনুশীলন শেষ করে তালিকা পাঠাতে হবে। মাসকেট্রি শব্দের অর্থ মাসকেট (পুরনো বন্দুক) চালানোর কৌশল বা অনুশীলন, গুলিবর্ষণ বা বন্দুক থেকে গুলি ছোড়া, রাইফেল শ্যুটিং বা বন্দুক চালনার প্রশিক্ষণ। যা সংক্ষেপে বন্দুক চালনার কৌশল / গুলিবর্ষণ / শ্যুটিং অনুশীলন।
পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, অস্ত্রের প্রাধিকার হিসেবে কনস্টেবল দায়িত্কালীন সময়ে ব্যবহার করতে পারেন চাইনিজ রাইফেল, শর্টগান, গ্যাসগান। নায়েক, এএসআই (সশস্ত্র) ব্যবহার করেন সাবমেশিন গান (এসএমজি), এএসআই (নিরস্ত্র) ব্যবহার করেন পিস্তল, এসআই (নিরস্ত্র), সার্জেন্ট, টিএসআই পেয়ে থাকেন পিস্তল আর পুলিশ পরিদর্শক থেকে তদুর্দ্ধ কর্মকর্তারা পেয়ে থাকেন পিস্তল। নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকালে ব্যবহার যোগ্য অস্ত্রের মাসকেট্রি চলছে বলে জানা গেছে সংশ্লিষ্ট সূত্রে।
সূত্র জানায়, এবারের নির্বাচনে পুলিশের ১৫৮ টি ইউনিট থেকে ৪ হাজার ৪৮৮ জন ইন্সপেক্টর (পরিদর্শক), ১৭ হাজার ৬৬৬ জন এসআই/ সার্জেন্ট/ টিএসআই, ২০ হাজার ১৩৫ জন এএসআই/এটিএসআই, ৫ হাজার ৯৪ জন নায়েক, ৯৯ হাজার ৩৮০ জন কনস্টেবল দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এর আগে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৫৬৩ জন পুলিশ দায়িত্ব পালন করেন। তৎকালীন সময়ে ভোটকেন্দ্র ছিল ৪২ হাজার ২৬ টি।