ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির দীর্ঘদিনের সুবিধা বাতিল করেছে ভারত। ফলে এখন থেকে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানির জন্য ভারতীয় ভূখণ্ড আর ব্যবহার করা যাবে না। ভারতের এ সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে কেমন প্রভাব পড়বে? হঠাৎ করে কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল ভারত, কারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এসব বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা বলেন, ভারতের এমন সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সাময়িক কিছুটা চাপে পড়বেন। কারণ, বাংলাদেশের বিমানবন্দরের সক্ষমতা কম। বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও বাফার সমন্বয়ের মাধ্যমে এটি সামাল দেওয়া সম্ভব। তবে আপাতত বাংলাদেশকে বিকল্প ট্রান্সশিপমেন্টের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া যতদিন দেশের বিমান বন্দরের সক্ষমতা বাড়ছে না ততদিন মালদ্বীপ, শ্রীলংকাসহ অন্য দেশের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ তারা বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাবে।
সূত্র মতে, ২০২০ সালের ২৯ জুন ভারত সরকার স্থল শুল্ক স্টেশন ব্যবহার করে বন্দর এবং বিমানবন্দর দিয়ে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানির জন্য বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেয়। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিপণ্য কনটেইনার বা কাভার্ডভ্যানের মাধ্যমে তৃতীয় দেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে ভারতের স্থল শুল্ক স্টেশন থেকে দেশটির অন্য কোনো বন্দর বা বিমানবন্দর পর্যন্ত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা পাবে। যা গত ৮ এপ্রিল বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল করেছে ভারত। যা নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ বিরাজ করছে। ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের ফলে ভারতের স্থলবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রপ্তানিতে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা পাবে না বাংলাদেশ। তবে নেপাল-ভুটানে স্থলপথে ট্রানজিট নিয়ে পণ্য পাঠানোয় জটিলতা থাকছে না।
ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলে ভারতীয় ভূখণ্ড দিয়ে নেপাল বা ভুটানে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে জানিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত বুধবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার ফলে আমাদের বিমানবন্দর ও বন্দরগুলোতে দীর্ঘ সময় ধরে যানজট তৈরি হয়েছিল। এতে লজিস্টিক বিলম্ব ও উচ্চ ব্যয় আমাদের নিজস্ব রপ্তানিকে বাধাগ্রস্ত করছিল। অনেক সময় আটকে যাচ্ছিল। তাই ৮ এপ্রিল থেকে এ সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো ভারতীয় ভূখণ্ড দিয়ে নেপাল বা ভুটানে বাংলাদেশের রপ্তানির ওপর প্রভাব ফেলবে না।
এর আগে ভারতের রপ্তানিকারকরা, বিশেষ করে পোশাক খাতের প্রতিবেশী বাংলাদেশকে দেওয়া এই সুবিধা প্রত্যাহারের জন্য নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে এই সুবিধা বাতিল করে নোটিশ জারি করে দেশটির সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডিরেক্ট অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি)। অনেকেই এটাকে রাজনীতিক সিদ্ধান্ত বলেও মনে করছেন।
গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (জিটিআরআই) সহ-প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব গণমাধ্যমে বলেন, এই পদক্ষেপের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। দুই দেশই এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক সম্পর্কে কিছুটা আঁচড় লাগবেই।
ভারতের এই ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে বাংলাদেশের তেমন কোনো সমস্যা হবে না বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল নিয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, হঠাৎ করে ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল করেছে ভারত। তারা আগে থেকে কিছুই জানায়নি। এতে বাংলাদেশের তেমন সমস্যা হবে না। আমাদেরকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংকট কাটাতে চেষ্টা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছি। সেখানে ক্রেতারাও উপস্থিত ছিলেন। আমরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংকট কাটাতে চেষ্টা করব। নিজস্ব সক্ষমতায় প্রতিযোগিতায় যেন কোনো ঘাটতি না হয় সেটা নিয়ে কাজ করছি। বাণিজ্যিক সক্ষমতা বাড়ানো হবে। একই সঙ্গে কাজ করছি যোগাযোগের ব্যাপারেও যাতে কোনো ঘাটতি না হয়, সেটিও নিশ্চিৎ করা হবে। কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, কিছু আছে অবকাঠামোগত বিষয়, কিছু আছে খরচ বৃদ্ধি, এসব নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি, সমস্যা কাটিয়ে উঠব। ভারতকে কোনো চিঠি দেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, এই মুহূর্তে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছি না।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, ভারতের এ সিদ্ধান্তে তারা সাময়িক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। বাংলাদেশ সরকার যদি দেশের কার্গো স্পেসের সমাধান করেন তাহলে এই ট্রান্সশিপমেন্ট সমস্যার সমাধান সম্ভব।
বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) তথ্য অনুসারে, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বড় বাজার আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, কানাডা, ওমান ও কাতার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১০০ দেশে ৩৪১ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন ডলারের খাদ্যপণ্য রপ্তানি করেছে। আগের অর্থবছরে ছিল ৩৮৩ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার। দেশের অন্যতম শীর্ষ খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ভারত, নেপাল, ভুটানসহ ১৪৫টির বেশি দেশে মসলা, জুস, মুড়ি, স্ন্যাকস ও কনফেকশনারি পণ্য রপ্তানি করে।
সূত্র মতে, বিশ্ব বাণিজ্যে পোশাক খাতে ভারতের অন্যতম বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ। ভারতীয় রপ্তানিকারকদের সংগঠন ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশনের (এফআইইও) মহাপরিচালক অজয় সাহাই গণমাধ্যমে বলেন, এ সিদ্ধান্তের ফলে এখন আমাদের কার্গো পরিবহনে অতিরিক্ত সক্ষমতা থাকবে। অতীতে রপ্তানিকারকরা বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেওয়ার কারণে বন্দর ও বিমানবন্দরে স্থান কম পাওয়ার বিষয়ে অভিযোগ করতেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, রপ্তানিকারকরা সাময়িক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিছু কিছু বায়ার ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা ব্যবহার করতে চায়। কারণ, আমাদের বিমানবন্দরের খরচ অনেক বেশি। কেউ কেউ দিল্লী, মাদ্রাজ ও মালদ্বীপ দিয়ে এয়ারশিপমেন্ট করায়। যারা এদিক দিয়ে পণ্য পাঠাতো, তাদের এখন বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। তিনি বলেন, কী কারণে আমাদের বিমানবন্দরের খরচ অনেক বেশি সেটা খুঁজে বের করা দরকার। এ সমস্যা সমাধান করাও জরুরি। আমাদের কেন অন্য দেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা নিতে হবে। সরকার কার্গো স্পেসের সমাধান করলে এই ট্রান্সশিপমেন্ট সমস্যারও সমাধান হয়ে যাবে বলে তিনি জানান।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, যখন বিশেষ কোনো পণ্য পাঠাতে হয়, বিশেষ করে যে দেশে পণ্য পাঠানো হবে সেই দেশের সঙ্গে সরাসরি কোনো কার্গো (জাহাজ) আমাদের দেশে না থাকে, সেক্ষেত্রে ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা নেওয়া হতো। এর মধ্যেমে ভারত রপ্তানিকারকেদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের রাজস্ব পায়। এখন ভারত এ সুবিধা না দিলে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের মতো দেশ থেকে এ সুবিধা গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রাথমিকভাবে কিছুটা চাপে পড়লেও বড় কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে না।
ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি ও টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ হিল রাকিব দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, আমরা মনে করি এটি আমাদের ব্যবসার ওপর তেমন প্রভাব ফেলবে না। এটি সাময়িক অসুবিধা হতে পারে। সরকার উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশ থেকেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। তবে ভারত বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাবে। কারণ, তারা আমাদের পণ্যের জন্য তাদের অতিরিক্ত কার্গো স্পেস বরাদ্দ রেখেছিল।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, প্রাথমিকভাবে এটি কিছুটা চাপ সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, আমাদের অতিরিক্ত কার্গো আগে ভারতীয় বিমানবন্দরগুলো দিয়ে যেত। এখন কোন দেশ থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা নেওয়া যায় তা বের করতে হবে। প্রয়োজনে আমরা শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের বিমানবন্দরগুলো ব্যবহার করব। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও বাফার সমন্বয়ের মাধ্যমে এটি সামাল দেওয়া সম্ভব। এখন আমাদের বিমানবন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা উন্নত করতে হবে। ঢাকা বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে এটির সক্ষমতা উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়বে বলে আমি মনে করি। একটি জাপানি কোম্পানি নতুন টার্মিনালের গ্রাউন্ড ও কার্গো অপারেশন পরিচালনা করবে, যা আমাদের সক্ষমতা আরও বাড়াবে।
অ্যাপারেল এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিলের (এইপিসি) চেয়ারম্যান সুধীর সেখরি এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রত্যেক দিন গড়ে প্রায় ২০ থেকে ৩০টি পণ্যবাহী ট্রাক দিল্লীতে আসত, যা কার্গোর চলাচল ধীর করে দিত এবং এয়ারলাইন্সগুলো এ ধীরগতির কারণে আমাদের থেকে অযৌক্তিক সুবিধা আদায় করত। এখন সেটি আর থাকবে না।
ভারতীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (জিটিআরআই) প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তবের মতে, এ সুবিধা প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশের রপ্তানি ও আমদানি কার্যক্রম ব্যাহত হবে। যদিও বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধি অনুযায়ী, স্থলবেষ্টিত দেশগুলো এবং সেসব দেশ থেকে অন্য দেশে পণ্যের অবাধ পরিবহনের অনুমতি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে সংস্থাটির সব সদস্যের। এর অর্থ এ জাতীয় ট্রানজিট অবশ্যই বাধাহীন হতে হবে এবং এসব পণ্য অপ্রয়োজনীয় বিলম্ব ও ট্রানজিট শুল্কমুক্ত থাকবে।