পুরো আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা পেল ইসি
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর গেজেট জারি করেছে সরকার। এতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের জোটগতভাবে নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করার বিধান যুক্ত করাসহ বেশ কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার আইন মন্ত্রণালয় এ অধ্যাদেশের গেজেট জারি হয়েছে। এর আগে গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশের খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। গেজেটে জাতীয় নির্বাচনে যুক্ত হয়েছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নতুন বিধান। সংশোধিত অধ্যাদেশে ‘না ভোট’ পুনরায় চালু হওয়া থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অপব্যবহারকে নির্বাচনী অপরাধ হিসেবে গণ্য করার মত নানা বিধান অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী মূল পরিবর্তনগুলো হল-আদালত ঘোষিত ফেরারি আসামী প্রার্থী হতে পারবেন না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনী (সেনা, নৌ, বিমান ও কোস্ট গার্ড) যুক্ত হয়েছে। একক প্রার্থীর আসনে ‘না ভোট’ ফিরছে। সমান ভোট পেলে লটারির বদলে পুনঃভোট হবে। জোটগত নির্বাচনে নিজ দলের প্রতীকে ভোট বাধ্যতামূলক।
এছাড়াও নির্বাচনী জামানত ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আচরণবিধি লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানা ও ছয় মাসের কারাদণ্ডের বিধান থাকবে। আইটি সাপোর্টে পোস্টাল ভোটিং পদ্ধতি যুক্ত হয়েছে। অনিয়ম প্রমাণিত হলে পুরো আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা ইসিকে দেওয়া হয়েছে। এআই-এর অপব্যবহার নির্বাচনী অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। হলফনামায় অসত্য তথ্য দিলে নির্বাচিত হওয়ার পরও ইসি ব্যবস্থা নিতে পারবে-এমন বিধান রাখা হয়েছে।
অনুচ্ছেদভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ও পরিবর্তন-
অনুচ্ছেদ ২: আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেনা, নৌ, বিমান ও কোস্ট গার্ডকে।
অনুচ্ছেদ ১২: আদালত ঘোষিত ফেরারি বা পলাতক আসামী সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সভাপতি বা কার্যনির্বাহী পদে থাকা ব্যক্তিও প্রার্থী হতে পারবেন না। ‘লাভজনক পদ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠানের কার্যনির্বাহী পদকেও সংজ্ঞায় আনা হয়েছে। হলফনামায় দেশ-বিদেশের আয়ের উৎস ও সর্বশেষ ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতে হবে।
অনুচ্ছেদ ১৯: একক প্রার্থী থাকলে ব্যালট পেপারে থাকবে ‘না ভোট’। তবে পুনঃনির্বাচনে ‘না ভোট’ প্রযোজ্য হবে না।
অনুচ্ছেদ ২০: জোটগত নির্বাচনে প্রতিটি দলকে নিজস্ব প্রতীকে ভোট করতে হবে।
অনুচ্ছেদ ২১: নির্বাচনী এজেন্ট অবশ্যই সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ভোটার হতে হবে।
অনুচ্ছেদ ২৬: ইভিএমে ভোটগ্রহণের বিধান বাতিল করা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ ২৭: পোস্টাল ভোটিংয়ের আওতায় প্রবাসী, সরকারি চাকরিজীবী এবং দেশের অভ্যন্তরে আটক ভোটাররা অন্তর্ভুক্ত থাকবেন।
অনুচ্ছেদ ২৯: ভোটকেন্দ্রে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশের সুযোগ রাখা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ ৩৬: ভোট গণনার সময় গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিত থাকার বিধান যুক্ত।
অনুচ্ছেদ ৩৮: সমান ভোট পেলে লটারির পরিবর্তে পুনঃভোট হবে।
অনুচ্ছেদ ৪৪: প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় ভোটারপ্রতি ১০ টাকা নির্ধারণ। দলীয় অনুদান ও ব্যয় সংক্রান্ত তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ বাধ্যতামূলক। নির্বাচন কর্মকর্তাদের বদলিতে উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ ৭৩: মিথ্যা তথ্য, গুজব বা এআই অপব্যবহার রোধে প্রার্থী ও দলের বিরুদ্ধে অপরাধের বিধান যুক্ত।
অনুচ্ছেদ ৯০: দল নিবন্ধন স্থগিত হলে সংশ্লিষ্ট দলের প্রতীকও স্থগিত থাকবে।
অনুচ্ছেদ ৯১: অনিয়ম প্রমাণিত হলে শুধু কেন্দ্র নয়, প্রয়োজনবোধে পুরো আসনের ফল বাতিলের ক্ষমতা ইসিকে দেওয়া হয়েছে। আচরণবিধি লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানা বা ছয় মাসের দণ্ডের বিধান। হলফনামায় অসত্য তথ্য দিলে ভোটের পরও ইসি ব্যবস্থা নিতে পারবে।
উল্লেখ্য, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ২৩ অক্টোবর গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) একগুচ্ছ সংস্কার এনে নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় উপদেষ্টা পরিষদ। আরপিওর একটি সংশোধনীকে কেন্দ্র করে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আপত্তি দেখা গেছে। আরপিওর ২০ অনুচ্ছেদে যে সংশোধনী আনা হয়েছে, তাতে জোটভুক্ত হলেও মনোনীত প্রার্থীকে তার দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে। আগের বিধান অনুযায়ী, নিবন্ধিত দলের জোটের প্রার্থীরা যে কোনো প্রতীকে ভোট করতে পারতেন। প্রধান দলগুলোর প্রতীক জোটভুক্ত ছোট দলের কয়েকজন প্রার্থীর ব্যবহারের সুযোগ ছিল এবং অতীতে তারা জিতেও এসেছেন। নিবন্ধিত দলের স্বাতন্ত্র্য, প্রতীকের জনপ্রিয়তাসহ কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় রেখে জোটভুক্ত হলেও স্ব স্ব প্রতীকে ভোটের বিধান চালুর সুপারিশ করে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। এ সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনও নানা সংস্কার প্রস্তাবে তা অন্তর্ভুক্ত রাখে। সবশেষ উপদেষ্টা পরিষদেরও অনুমোদন পেয়েছে বিষয়টি। কিন্তু বিএনপি আরপিওর ২০ অনুচ্ছেদের সংশোধনী নিয়ে আপত্তি তুলেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে লিখিত আবেদন করার পাশাপাশি বিধানটি বাদ দিয়ে আগের অনুচ্ছেদই বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে দলটি। বিএনপির জোটসঙ্গী কয়েকটি দলও ইসিতে চিঠি দিয়েছে, বিক্ষোভ করেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ আইন উপদেষ্টার সঙ্গেও এ নিয়ে বৈঠক করেছেন।
২৮ অক্টোবর আইন উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনার পর তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আগেও আমি বিষয়টি আইন উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন যে এটা তিনি সরকারের নজরে আনবেন। তিনি নিশ্চয় সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন এবং সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টারা এটা নিয়ে আলোচনা করেছেন। অধ্যাদেশটি কেবিনেটে পাস হওয়ার পর দেখলাম, বিবেচিত হয়নি।
এরপর জামায়াতের পক্ষ থেকে সিইসির সঙ্গে বৈঠক করে সংশোধনী বহাল রাখার দাবি জানানো হয়। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, কোনোভাবেই সংশোধিত বিধান পরিবর্তন করা যাবে না। জোটে ভোট করলেও স্ব স্ব দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে।
জামায়াতের নায়েবে আমীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অভিযোগ করে বলেন, অগোচরে আরপিও সংশোধন করছে উপদেষ্টা পরিষদ, যা একটি দলের কাছে সরকারের নতি স্বীকার।
বিএনপিসহ কয়েকটি দল আরপিও-এর ২০ অনুচ্ছেদের আগের বিধান বহাল চেয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ ৮ দল সংশোধিত আরপিও বহাল রাখার পক্ষে।
এরইমধ্যে জামায়াতে ইসলামীসহ আটটি দল সিইসির সঙ্গে বৈঠক করে স্মারকলিপিও দিয়েছে। গত রোববার আইন উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। দলের সচিব আখতার হোসেন সেখানে লিখেছেন, “সাম্প্রতিক সময়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ২০ অনুচ্ছেদ সংশোধন সংক্রান্ত আলোচনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিকে দেওয়া আপনার ব্যক্তিগত আশ্বাস ও অবস্থান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, একজন উপদেষ্টা হিসেবে আপনি রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ আইন উপদেষ্টা, কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নন। নির্বাচনী আইন সংশোধনের মত বিষয়ে কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে এককভাবে আশ্বাস প্রদান করা জুলাই গণঅভুথান পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পদের নিরপেক্ষতা ও দায়বদ্ধতার পরিপন্থি।
রোববার এনসিপি প্রতিনিধি দল তাদের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের একটি চিঠি সিইসির কাছে জমা দেন। সেখানে বলা হয়, “আমরা মনে করি, প্রতিটি নিবন্ধিত দলকে তাদের নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করার যে সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন নিয়েছে তা একটি ঐতিহাসিক ও নীতিগতভাবে সঠিক পদক্ষেপ।
এদিকে গত সোমবার ১২টি দলের পক্ষে সংশোধনী বাতিল করার দাবি নির্বাচন কমিশনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মহাসচিব আহসান হাবীব লিবসন লিখিত দাবিটি ১২ দলের পক্ষে সিইসির দপ্তরে জমা দেন। অন্য দলগুলো হলো-লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, জাতীয় দল বাংলাদেশ, জমিয়াতে উলামায়ে ইসলাম, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, নয়া গণতান্ত্রিক পার্টি, ইসলামিক পার্টি, প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী দল ও ইউনাইটেড লিবারেল পার্টি।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলেও শরিক দলগুলোকে নিজ নিজ দলীয় প্রতীক ব্যবহার করতে হবে-গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) এমন সংশোধনীতে ১২ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে আমরা আপত্তি জানাচ্ছি। এই পরিবর্তন আমাদের কাছে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
আরপিও সংশোধন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনের সচিব আখতার আহমেদ বলেন, উপদেষ্টা পরিষদে এর নীতিগত অনুমোদনের পর বাকি কাজটুকু করে আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ডিভিশন। তারা অধ্যাদেশ জারি করেন। কাজেই অধ্যাদেশ জারির বিষয়টি যতক্ষণ না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা অপেক্ষায় আছি।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাদের এখান থেকে নতুন করে বলার মতো কিছু নেই। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, আইন মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত অবস্থান জানার পরেই এ বিষয়ে কথা বলা যাবে।