# আইনি ভিত্তির জন্য নির্বাচনের আগেই গণভোট চায় জামায়াতে ইসলামী
# জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট চায় বিএনপি
# দ্রুত বাস্তবায়নের পক্ষে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ
জুলাই সনদ ইস্যুতে গণভোটের পক্ষে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। গতকাল রোববার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চতুর্থ দিনের আলোচনা শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা জানান। আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে এক ধরনের রাজনৈতিক ঐক্যে পৌঁছেছে দলগুলো। এটি বড় ধরনের অর্জন। আশা করি, অন্যান্য বিষয়েও দ্রুত একমত হবো। আগামী ৮ অক্টোবর এ বিষয়ে আবারও বৈঠকে বসবে কমিশন।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এ বিষয়ে ইতোপূর্বে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এখন অনেকে এ বিষয়ে কিছুটা সরে আসছেন। এ জন্য দলগুলোকে ধন্যবাদ। আশা করি, একটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দিতে পারবো। প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, আমরা ১৫ অক্টোবরের মধ্যে একটি মিমাংসায় আসতে পারবো। তিনি জানান, জুলাই সনদে স্বাক্ষর করার বিষয়ে তিন চতুর্থাংশ দলের কাছে নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। অনেকে নাম দিয়েছেন, অনেকে এখনও দেননি। দ্রুত নাম দিতে তিনি দলগুলোকে অনুরোধ করেন। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আরও জানান, দুই-এক দিনের মধ্যে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আবারও বৈঠকে বসবে কমিশন।
বৈঠকে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, এলডিপি, গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), আমার বাংলাদেশ পার্টিসহ (এবিপার্টি) ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি অংশ নেন। কমিশনের সদস্য হিসেবে ছিলেন– বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
বিএনপির ব্রিফিং : বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট হতে পারে। তিনি বলেন, ‘সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোটে কোনো বাধা নেই। সনদে কী থাকবে, তা জনগণের কাছে উন্মুক্ত থাকবে। এই রায় হবে চূড়ান্ত। আগামী সংসদ গণভোটের রায় মানতে বাধ্য থাকবে।
বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় ফাইনাল স্টেজে আমরা আছি। মোটামুটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে, একমত হয়েছি। এ সময় জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ অধ্যাদেশ জারি করা যেতে পারে বলেও জানান তিনি। নোট অব ডিসেন্ট থাকা বিষয় দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে থাকবে বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমদ। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘১০৬ অনুচ্ছেদে আওতায় বিচার বিভাগের পরামর্শ নেওয়ার দাবি থেকে সরে এসেছে বিএনপি। আমরা এখন জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ নামে অধ্যাদেশ জারি এবং তারপরে গণভোটের পক্ষে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী : আলোচনার বিরতিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আইনি ভিত্তির জন্য গণভোটের বিষয়ে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল একমত। তবে তাঁদের দল গণভোট নির্বাচনের আগেই চায়।
গণভোট কবে হতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ‘জনগণ গণভোটে অভ্যস্ত নয়। আমরা মনে করি, জাতীয় নির্বাচনকে কোনো ধরনের সমস্যা করা ছাড়া নভেম্বর অথবা ডিসেম্বরে এটা হতে পারে। তফসিলের আগেও হতে পারে। গণভোট হয়ে গেলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে কোনো ধরনের বাধা নেই। জনগণকে একটা জটিল অবস্থায় ফেলে না দিয়ে সহজভাবে এগোলে আমরাও বাঁচি, জাতিও বাঁচে। জামায়াতের এই নেতা বলেন, গণভোট হলে এটা কখনো চ্যালেঞ্জ করতে গেলে টিকবে না। পার্লামেন্ট এটাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না।
হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘গণভোটের রেজাল্ট যদি আমাদের বিপক্ষেও যায়, আমরা এখানে ছাড় দেব। আমরা জনগণের সিদ্ধান্তকে মেনে নেব। এটি নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। এক প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের এই নেতা বলেন, গণভোট আগে না পরে, এটা আলোচনার সুযোগ আছে। সবাই গণভোটের পক্ষে একমত হয়েছে। গণভোট আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে একটা নিদের্শনা দিতে হবে। এরপর কমিশন গণভোটের আয়োজন করতে পারবে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান ও জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ : জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে বৈঠকের পর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্মমহাসচিব ও দলীয় মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, আমরা রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ মিলে একটা সনদ তৈরি করেছি। সেই সনদ আমাদের প্রত্যাশা পূরণ না করলেও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আমরা তা মেনে নিয়েছি। এখন এটা বাস্তবায়ন করা সরকারের কাজ। সরকার এই বাস্তবায়নের বিষয়টিও রাজনৈতিক তর্কের ওপরে ছেড়ে দিলে জটিলতা বাড়বে।
মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার পালানো, এর পরে সরকার গঠন করা কোনটাই তো সংবিধান পুরোপুরি মান্য করে হয় নাই। ফলে জুলাই সনদের বাস্তবায়নে সংবিধানের দোহাই দিয়ে পরবর্তী সংসদের ওপরে এর বাস্তবায়ন ন্যাস্ত করলে রাষ্ট্র সংস্কারে এই সরকারের অঙ্গিকার ব্যাহত হবে। আর তাই যদি হয় তাহলে জুলাইয়ে এতো এতো রক্ত-জীবন বৃথা যাবে। আমরা সেটা হতে দিতে পারি না। তাই সরকারকে বলবো, অভ্যুত্থানের প্রত্যাশাকে আমলে নিয়ে এই দ্রুততার সাথে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করুন।
এদিকে খুব শিগগিরই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে বলে জানিয়েছেন কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। গতকাল সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় কমিশন সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এক বৈঠকে এ কথা জানান তিনি। ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে জুলাই সনদের বিষয়বস্তু ও এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব ও এবিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের অবস্থান সম্পর্কে সভাকে অবহিত করা হয়। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ঐকমত্য কমিশনের কাজের অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ঐকমত্য কমিশন সকল রাজনৈতিক দল থেকে ব্যাপকভাবে সহযোগিতা পেয়েছে। এছাড়া, গণমাধ্যমগুলো ঐকমত্য কমিশনকে অকল্পনীয় সমর্থন দিয়েছে। কমিশন সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস কমিশনের সকল সদস্যদের ধন্যবাদ ও শুভ কামনা জানিয়েছেন। কমিশনের কাজের চুড়ান্ত অগ্রগতি সম্পর্কে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাঁকে জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
বৈঠকে কমিশনের পক্ষ থেকে বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ, কমিশন সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন। পাশাপাশি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, আসিফ নজরুল ও আদিলুর রহমান খান বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গতম ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হওয়া জুলাই জাতীয় সনদের খসড়া ইতোমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে। এর আগে, ১৭ সেপ্টেম্বর কমিশনের সঙ্গে এক দফা আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে একটি বাস্তবায়ন কাঠামোর প্রস্তাব তুলে ধরেছিল কমিশন। প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকার মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবগুলোকে ভিত্তি করে একটি ‘সংবিধান আদেশ’ জারি করতে পারে, যা অবিলম্বে কার্যকর হবে। পরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে সেই আদেশটি নিয়ে গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে আদেশটির গণতান্ত্রিক বৈধতা নিশ্চিত করা যাবে।
কমিশন সূত্র বলছে জানিয়েছে, আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যেই জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত সংস্করণে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষর নিশ্চিত করতে চায় তারা। জুলাই জাতীয় সনদকে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছিল।
এতে সংবিধান সংশোধন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ, নাগরিক অধিকার নিশ্চিতকরণসহ মোট ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। খসড়া তৈরির পুরো প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও আইন বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।