ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের জন্য দেড় লাখ পুলিশের প্রশিক্ষণ শুরু হচ্ছে আজ। সাড়ে তিন মাসব্যাপী এ প্রশিক্ষণ চলবে আগামী জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। সারা দেশের ১৩০ টি নির্ধারিত কেন্দ্রে এই প্রশিক্ষণ চলবে। প্রশিক্ষণ দেবেন দুই হাজার ৩৬৫ জন প্রশিক্ষক। পুলিশের কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর (পরিদর্শক) পদ মর্যাদার সদস্যদের এই প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। প্রতিটি ব্যাচের প্রশিক্ষণের মেয়াদ হবে তিন দিনের। খবর পুলিশ সদর দফতর সূত্রের।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনই দেশবিদেশে বিতর্কিত হয়। বিশেষ করে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাতের ভোটের জন্য পুলিশকে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়। কতিপয় দলকানা পুলিশ সদস্যের অতিউৎসাহী মনোভাব ও নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারনে এই নির্বাচনের কালিমা বয়ে বেড়াচ্ছে গোটা পুলিশ বাহিনী। এবার পুলিশের সামনে এসেছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে ২০১৮ সালের রাতের ভোটের সেই কলংক মুছতে চায় পুলিশ। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই আগামী নির্বাচনে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য দেড় লাখ পুলিশকে প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, আজ ৫ অক্টোবর রোববার থেকে শুরু হচ্ছে ৪র্থ ও শেষ ধাপের মাঠ পর্যায়ের নির্বাচনি প্রশিক্ষণ। সারা দেশে ১৩০টি ভেন্যুতে কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পর্যন্ত মাঠ পুলিশ সদস্যরা এই প্রশিক্ষণ নেবেন। ২৩৬৫ জন প্রশিক্ষক তাদের এই প্রশিক্ষণ দেবেন।
সূত্র জানায়, দেশের ৬৪ জেলা, ৮ টি মেট্রোপলিটন, ২১ টি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), ১৩ টি বিশেষায়িত পুলিশের ইউনিট ও এলিটফোর্স র্যাবের নির্ধারিত ১৩০ টি কেন্দ্রে আজ থেকে শুরু হওয়া এই প্রশিক্ষণ চলবে জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত। প্রতিটি কেন্দ্রে এতো সংখ্যক পুলিশ সদস্যের প্রশিক্ষনের জন্য ৫০ জন সদস্য করে এক একটি ব্যাচ করা হয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রের ব্যাচ সংখ্যা হচ্ছে ২৮ টি। প্রতিটি ব্যাচের প্রশিক্ষণ চলবে তিন দিন। সূত্র মতে, পুলিশের তিন দিনের প্রশিক্ষনের জন্য ১৬ টি সেশনে প্রশিক্ষণ দেবেন প্রশিক্ষকরা। দুটি সেশনে দেখানো হবে পুলিশের তৈরী করা নির্বাচনী ডক্যুমেন্টরী। এরপর ১০ টি সেশনে দেয়া হবে একােিডমিক প্রশিক্ষণ। পরবর্তী ৪ টি সেশনে দেয়া হবে বডিঅর্ণ ক্যামেরা ও অস্ত্রের প্রশিক্ষণ।
সূত্র জানায়, আগামী ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হচ্ছে র্যাবের প্রশিক্ষক বাছাইয়ের প্রশিক্ষণ (টট)। তিন দিনব্যাপী দুই ব্যাচের ( প্রতি ব্যাচে ৪০/৫০ জন) এই প্রশিক্ষনে ৭০/৮০ জন প্রশিক্ষক তৈরী করা হবে। এদের দিয়েই নির্বাচনী প্রশিক্ষণ দেয়া হবে র্যাব সদস্যদের।
জানতে চাইলে নির্বাচনি প্রশিক্ষণের প্রধান সমন্বয়ক পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত আইজি (এইচএন্ডআর) আবু নাছের মোহাম্ম খালেদ গতকাল দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, নির্বাচনে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে মাঠ পুলিশের দেড় লাখ সদস্যকে আইন, বিধি বিধান, অস্ত্র ব্যবহার , বডিঅর্ন ক্যামেরাসহ আরও নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এজন্য আমরা ১৪৬ জন মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করেছি। তাদের তৈরী করেছেন ১০ জন লীড ট্রেইনার। সবমিলে প্রশিক্ষক তৈরী করা হয়েছে দুই হাজার ৩৬৫ জন। তারা এখন মাঠ পুলিশকে প্রশিক্ষিত করবেন। আমরা আন্তর্জাতিকমানের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। তিনি বলেন, এর আগে কখনও এত বড় পরিসরে পুলিশের নির্বাচনি প্রশিক্ষণ হয়নি। আগামী ১৫ জানুয়ারি সব ধরনের প্রশিক্ষণ শেষ করে দেড়লাখ পুলিশ সদস্যকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করবো আমরা। তিনি আশা প্রকাশ করেন, প্রশিক্ষিত পুলিশ সদস্যদের দিয়ে আগামীর জাতীয় নির্বাচনটি হবে উৎসবমূখর ও কলংকমুক্ত।
জানা গেছে, ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতার অপব্যবহার, অপরাধমূলক অসদাচরণ, জাল-জালিয়াতি, দিনের ভোট রাতে করা এবং আর্থিক লেনেেনর অভিযোগে চরম বিতর্কিত হয়ে পড়ে পুলিশ বাহিনী। আগামী জাতীয় নির্বাচনে সেই কলঙ্কমোচনের বড় সুযোগ হিসেবে দেখছেন পুলিশের কর্মকর্তারা। আজ থেকে শুরু হওয়া মাঠ পুলিশের প্রশিক্ষণকালে এ বিষয়টি বারবার স্মরণ করিয়ে দেবেন মাস্টার ট্রেইনারগণ। নির্বাচনকালে কোন দল বা গোষ্ঠীর হয়ে পুলিশ সদস্যরা যেন কাজ না করেন এজন্য দায়িত্ব পালনকালে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের ওপরও গুরুত্বারোপ করা হবে প্রশিক্ষণে। পক্ষালম্বন করলে কী পরিণতি হতে পারে এ বিষয়টিও স্মরণ করে দেওয়া হবে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মাঠ পুলিশকে নির্বাচনের পূর্ব, নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন পরবর্তী তিন ধরনের নির্বাচননি দায়িত্ব পালনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তিনদিন ব্যাপী এই প্রশিক্ষণে প্রথম দিন নীতিগত জ্ঞান ও আইনি কাঠামো, দ্বিতীয় দিন বাস্তব প্রস্তুতি ও ব্যবহারিক অনুশীলন এবং তৃতীয় দিন অস্ত্র এবং বডিঅর্ন ক্যামেরা ব্যবহারের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
প্রশিক্ষণ মডিউলকে বিভিন্ন সেশনে ভাগ করা হয়েছে। প্রশিক্ষণের শুরুতেই একটি ডকুফিল্ম প্রদর্শন ও মুক্ত আলোচনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এরপর নির্বাচনি আইন, আচরণবিধি ও ভোটার অধিকার, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা ও আইন অনুযায়ী পুলিশের দায়িত্ব, গোয়েন্দাতথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ; আন্তঃসংস্থা বা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় সাধনের কর্মপন্থাা; সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষায় সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় ও স্থানীয় গণ্যমাণ্য নেতৃবৃন্দকে সম্পৃক্ত করতে পুলিশের ভূমিকার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। নির্বাচন পূর্ব দায়িত্ব হিসেবে পুলিশ মোতায়েনকালে বিবেচ্য বিষয়সমূহ ও করণীয়; ভোটকেন্দ্রে ফোর্স মোতায়েন পরিকল্পনা এবং নির্বাচনি সহিংসতা মোকাবিলার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
নির্বাচনকালীন সময়ে কীভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে তার দিক নির্দেশনাও দেয়া হবে প্রশিক্ষণে। এর মধ্যে নির্বাচনি সামগ্রী, ভোটার, ভোটকেন্দ্র ও বুথের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে পুলিশের আইনানুগ দায়িত্ব; ভোটের দিন মোবাইল, স্ট্রাইকিং এবং রির্জাভ ফোর্সের কর্মবণ্টন,পারস্পরিক যোগাযোগ ও সমন্বয় প্রক্রিয়া; এবং দেশি ও বিদেশি নির্বাচনি পর্যবেক্ষক ও সংশ্লিষ্ট সকলকে নিরাপত্তা বিধানে পুলিশের করণীয় বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এছাড়া নির্বাচন সামগ্রী রিটার্নিং কর্মকর্তার/সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে নিরাপদে পৌঁছে দিতে পুলিশের ভূমিকা, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত দুর্গম এলাকায় নির্বাচনি ডিউটি পালনে করণীয় ও বর্জনীয়, মিডিয়া ব্যবস্থাপনা, মিথ্যা তথ্য, অপপ্রচার ও গুজব নিরসনে বা প্রতিরোধ পুলিশের ভূমিকা এবং আচরণবিধি লঙ্ঘন সংক্রান্ত ঘটনা রিপোর্টিং পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। কোন কিছু না বুঝলে মাস্টার ট্রেইনারদের কাছে জানতে চাইবেন প্রশ্নোত্তর পর্বে, সে সুযোগও থাকছে।
নির্বাচন পরবর্তী দায়িত্ব সম্পর্কেও মাঠ পুলিশকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। বিশেষ করে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা প্রতিরোধে পুলিশের ভূমিকা, জরুরী উদ্ধার এবং চিকিৎসা সহায়তা সেবা প্রদানে পুলিশের করণীয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করবেন মাঠ পুলিশের সদস্যরা। এ বিষয়ে প্রশ্নোত্তর পর্বও থাকবে। এছাড়া মক ভোটকেন্দ্র ব্যবস্থাপনার ডকুমেন্টারি প্রদর্শন, ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের প্রকৃত চিত্র, পুলিশের কতটুকু দায়িত্ব, অপ্রত্যাশিত ঘটনায় করণীয়, এবং রিপোর্টিং চ্যানেল ইত্যাদি সম্পর্কে রোল প্লের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
গত সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে পুলিশ নির্বাচনি প্রশিক্ষনের সকল আয়োজন শুরু করে। যার সমাপ্তি ঘটবে ১৫ জানুয়ারি।