* যুদ্ধ শেষ করতে চায় ইসরাইল, ইরানের কাছে পাঠিয়েছে বার্তা
* ইরান শেষ পর্যন্ত ‘লড়তে প্রস্তুত’---ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী সাঈদ খতিবজাদে
* ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরাইলে ব্যাপক বিদ্যুৎ বিভ্রাট
মার্কিন সামরিক ঘাঁটি ও ইসরাইলের ওপর একযোগে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইরান। দেশটির ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) এই হামলা চালানোর কথা জানিয়েছে। পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইসরাইলও, তবে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরাইলে ব্যাপক বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর হামলার পর ইরানের সঙ্গে দ্রুত যুদ্ধ শেষ করার পরিকল্পনা করছে ইসরাইল, ইরানের কাছে পাঠিয়েছে বার্তা। ইরান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পর ইসরাইলের বিভিন্ন এলাকায় সাইরেন বেজে ওঠার পর আতঙ্কে তেল আবিবের ভূগর্ভস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে জড়ো হতে থাকে মানুষ। সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা ভাষ্য অনুযায়ী, ইসরাইলের পাঁচটি স্থানে; সাফাদ, তেল আবিব, আশকেলন, আশদোদ এবং বেইসানে রকেট হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে এই হামলার পর এখনও পর্যন্ত ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য আসেনি। এছাড়া ইরানের আরও হামলার আশঙ্কায় নাগরিকদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয়ের নির্দেশ দিয়েছে ইসরাইল। এছাড়াও ইরান যতদিন প্রয়োজন, ততদিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে প্রস্তুত এ কথা জানিয়েছেন ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক উপমন্ত্রী সাঈদ খতিবজাদে। তবে এই পর্যন্ত ইসরাইলের হামলায় কমপক্ষে ৯৫০ জন নিহত এবং ৩,৪৫০ জন আহত হয়েছে ইরানের নাগরিক। পুতিনকে খোমেনির চিঠি দিয়েছেন এবং তেহরানে ‘অযৌক্তিক আগ্রাসন’ চালিয়েছে ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্র বলে অভিযোগ করেছেন পুতিন। গতকাল সোমবার এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা, টাইমস অফ ইসরাইল, আরব নিউজ, হিব্রু নিউজ, মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, এপি, এএফপি ।
ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) ঘোষণা করেছে, তারা ইসরাইলের ওপর একযোগে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। ইরানি সংবাদমাধ্যম তাসনিম জানায়, এই হামলায় কঠিন ও তরল জ্বালানিচালিত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের পাশাপাশি এমন কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে, যা ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করতে সক্ষম। অন্যদিকে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কিছু সময় পরেই ইসরাইল তেহরানসহ অন্যান্য ইরানি শহরে পাল্টা হামলা চালিয়েছে। আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পশ্চিম তেহরানের অধ্যাপক ফোয়াদ ইযাদি জানিয়েছেন, একটি হাসপাতালে পাশে ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে এবং ঘটনাস্থলে ধোঁয়া দেখা গেছে। এমন অবস্থায় ইসরাইলি সেনাবাহিনী সতর্ক করে জানিয়েছে, ইরান থেকে আরও ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হচ্ছে। জনগণকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দেশটিতে ফের বিমান হামলার সতর্কতা বাজানো হয়েছে।
যুদ্ধ শেষ করতে চায় ইসরাইল, ইরানের কাছে পাঠিয়েছে বার্তা: ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর হামলার পর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সঙ্গে দ্রুত যুদ্ধ শেষ করার পরিকল্পনা করছে ইসরাইল। এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার আরব মিত্রদের মাধ্যমে ইরানের কাছে ইসরাইলের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। আরব ও ইসরাইলি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে সোমবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। ইসরাইলি টেলিভিশন চ্যানেল-১২ এর খবরে বলা হয়েছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ‘অপারেশন রাইজিং লায়নের’ মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হুমকি নির্মূল করে নিজেদের সামরিক লক্ষ্য খুব দ্রুত অর্জন করতে পারবে বলে প্রত্যাশা ইসরাইলের। আরবের কর্মকর্তারা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেছেন, ইসরাইল এই অভিযান শিগগিরই শেষ করতে চায় বলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের আরব মিত্রদের মাধ্যমে ইরানকে বার্তা দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাব দেওয়া ছাড়া ইরান এখনই অভিযান শেষ করতে চায় না।
ইসরাইলি এক কর্মকর্তা রোববার টাইমস অফ ইসরাইলকে বলেছেন, ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি বাতিল করতে রাজি হলে ইসরাইল এখনই বোমা হামলা বন্ধ করার জন্য প্রস্তুত আছে। তিনি বলেন, এই অভিযান বন্ধের বিষয়টি আমাদের ওপর নয়, বরং ইরানের ওপর নির্ভর করছে। আমরা চাইলে এখনই শেষ করতে পারি। সেক্ষেত্রে যদি একটি চুক্তি হয়, তাহলে ইসরাইল তার অভিযানের ফলাফলে সন্তুষ্ট থাকবে। চ্যানেল-১২ এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযান শেষ করার দুটি পথ খোলা রয়েছে। প্রথমত, ইসরাইল একতরফাভাবে ঘোষণা করতে পারে যে, তারা তাদের যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন করেছে এবং ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বন্ধ করেছে। দ্বিতীয়ত, উভয়পক্ষই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিতে পারে। যদিও ইসরাইল এটিকে কম গ্রহণযোগ্য হিসেবে মনে করে।
ইরান শেষ পর্যন্ত ‘লড়তে প্রস্তুত’: ইরান যতদিন প্রয়োজন, ততদিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে প্রস্তুত এ কথা জানিয়েছেন ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক উপমন্ত্রী সাঈদ খতিবজাদে। আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ইরান ইসরাইলের ‘অযৌক্তিক, বেপরোয়া এবং উগ্র কর্মকা-’ থামানোর জন্যই কাজ করছে। খতিবজাদে আরও বলেন, ১৩ জুন থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলের ‘অন্যায়’ এবং ‘অযৌক্তিক’ হামলার জবাব দিতে ইরান অত্যন্ত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘আমরা এই লড়াই চালিয়ে যাব। ’ উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইরান-ইরাক যুদ্ধ, যেখানে ইরান আত্মরক্ষার জন্য দীর্ঘ সময় যুদ্ধ চালিয়েছিল। ‘আমরা শেষ পর্যন্ত লড়ার জন্য প্রস্তুত,’ বলেন তিনি।
মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ইরানের হামলা: ইরান-ইসরাইলের চলমান সংঘাতের মধ্যে এবার সিরিয়ায় একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে মর্টার হামলা হয়েছে। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হাসাকাহ প্রদেশের কাসরুক এলাকায় এ হামলার ঘটনা ঘটে। সোমবার ইরানের সংবাদমাধ্যম মেহের নিউজ এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, কাসরুক অঞ্চলে মার্কিন ঘাঁটিতে হঠাৎ করে মর্টার হামলা চালানো হয়। তবে এ হামলা কে করেছে, হামলার ধরন বা এতে কী পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সে বিষয়ে এখনও স্পষ্ট কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। ঘটনার পরপরই মার্কিন সেনারা পুরো ঘাঁটির চারপাশ ঘিরে ফেলে এবং ওই এলাকায় নজরদারি বাড়িয়ে দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এলাকাজুড়ে সামরিক ড্রোন ও হেলিকপ্টারের টহল লক্ষ্য করা গেছে।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরাইলে ব্যাপক বিদ্যুৎ বিভ্রাট: বড় ধরনের এই হামলার পরই ইসরাইলে ব্যাপক বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিয়েছে। এর জেরে ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কিছু শহরে বিদ্যুৎ পরিষেবা ব্যাহত হয়েছে। গতকাল সোমবার এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, দক্ষিণ ইসরাইলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বেশ কয়েকটি এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। টাইমস অব ইসরাইল জানিয়েছে, ইসরাইল ইলেকট্রিক করপোরেশন (আইইসি) নিশ্চিত করেছে যে, একটি ক্ষেপণাস্ত্র “কৌশলগত অবকাঠামো স্থাপনার” কাছে সরাসরি আঘাত লেগেছে। এর ফলে আশপাশের বেশ কয়েকটি শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। এক বিবৃতিতে আইইসি জানায়, দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনঃস্থাপনের লক্ষ্যে আমাদের টিমগুলো এখনই ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হয়েছে। এ সময় অবকাঠামোর মেরামত এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি অপসারণের কাজ চলছে, যা নিরাপত্তা বাহিনীর সমন্বয়ে পরিচালিত হচ্ছে।
ইরানে ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ৯৫০ জন নিহত এবং ৩,৪৫০ জন আহত: গতকাল সোমবার একটি মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, ইরানে ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ৯৫০ জন নিহত এবং ৩,৪৫০ জন আহত হয়েছে। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গোষ্ঠী হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টস এই পরিসংখ্যান প্রদান করেছে, যা সমগ্র ইরানকে অন্তর্ভুক্ত করে। তারা জানিয়েছে যে নিহতদের মধ্যে ৩৮০ জন বেসামরিক ব্যক্তি এবং ২৫৩ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছেন।
মানবাধিকার কর্মীরা, যারা মাহসা আমিনির মৃত্যুর বিরুদ্ধে ২০২২ সালের বিক্ষোভের সময় হতাহতের বিস্তারিত পরিসংখ্যানও প্রদান করেছিল, তারা ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের স্থানীয় প্রতিবেদনগুলিকে দেশে গড়ে ওঠা উৎসের নেটওয়ার্কের সাথে তুলনা করে। ইরান সংঘাতের সময় নিয়মিত মৃতের সংখ্যা প্রকাশ করেনি এবং অতীতে হতাহতের সংখ্যা কমিয়ে এনেছে। শনিবার ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে ইসরাইলি হামলায় প্রায় ৪০০ ইরানি নিহত এবং আরও ৩,০৫৬ জন আহত হয়েছেন। (এএফপি)
পুতিনকে খোমেনির চিঠি এবং তেহরানে ‘অযৌক্তিক আগ্রাসন’ চালিয়েছে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র: ইরানে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের চালানো হামলাকে ‘বিনা উসকানিতে আগ্রাসন’ বলে অভিহিত করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। চলমান এই সংঘাতে মস্কো ইরানি জনগণকে সহায়তা করার চেষ্টা করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। গতকাল সোমবার মস্কোতে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচির সঙ্গে বৈঠকে এই মন্তব্য করেন রুশ প্রেসিডেন্ট। এছাড়াও পুতিনকে চিঠি দিয়েছেন খোমেনি।
ইরানের তিন পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর হামলার পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করতে মস্কো সফরে গেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি। সোমবার সকালে তাদের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে তেহরানে চালানো ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে ‘‘বিনা উসকানির আগ্রাসন’’ বলে আখ্যায়িত করেন পুতিন। পুতিন বলেন, ‘‘এটি ইরানের বিরুদ্ধে একেবারে বিনা উসকানিতে আগ্রাসন।’’ তিনি এই হামলাকে ‘অযৌক্তিক’ বলেও উল্লেখ করেন। রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, রাশিয়া ইরানি জনগণকে সহায়তা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।