গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরকে নির্মমভাবে পিটিয়ে আহত করার ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। তীব্র নিন্দা এবং লোমহর্ষক এ ঘটনার তদন্ত করে সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এছাড়া হামলার নিন্দা জানিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এক বিবৃতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশবাসীকে আশ্বস্ত করছে যে, এ ঘটনায় দ্রুততম সময়ে একটি নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত পরিচালনা করা হবে। সার্বিক পরিস্থিতিতে জরুরি বৈঠক করেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। হামলার ঘটনায় উচ্চ পর্যায়ের জুডিশিয়াল তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সরকার। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। এদিকে মব ভায়োলেন্স’ থামাতে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয় বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।

গুরুতির আহত নুরুল হক নুর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন। হামলায় তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে এবং নাক ও চোয়ালের হাড় ভেঙে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। তার উন্নত চিকিৎসায় এরই মধ্যে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। চিকিৎসকরা বলেছেন তিনি এখনো পর্যবেক্ষণে আছেন।

গতকাল শনিবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক (আরএস) ডা. মোস্তাক আহমেদ বলেন, আঘাতের কারণে নুরুল হক নুরের নাক ও চোয়ালের হাড় ভেঙে গেছে এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। এছাড়া তার চোখে রক্তজমাট আছে। হাসপাতালের নিউরো সার্জারি, নাক-কান-গলা বিভাগ, আইসিইউ বিভাগের প্রধানসহ আরও কয়েক বিভাগের সিনিয়র চিকিৎসকদের নিয়ে একটি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। নুরের আরেকটি সিটি স্ক্যান করে দেখা হবে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের অবস্থা বেড়েছে নাকি কমেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, নুরের চিকিৎসায় এরই মধ্যে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বোর্ড আজ আলোচনায় বসবে। নুরের জ্ঞান ফিরেছে, মাথায় ও নাকে আঘাতের চিহ্ন আছে। ৪৮ ঘণ্টা না গেলে কিছু বলা যাচ্ছে না।

গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত মেরুন কালারের টি-শার্ট পরিহিত ওই ব্যক্তি পুলিশের কনস্টেবল বলে জানা গেছে। তার নাম মিজানুর রহমান। বিপি নং- ৯৭১৭১৯৭২৪৩। সে ছাত্রনেতা সম্রাটের ওপর হামলা করেছে। গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খাঁন তার ফেসবুক পোস্টে জানান। একই তথ্য জানিয়েছেন, গণঅধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদ সদস্য ও গণমাধ্যম সমন্বয়ক আবু হানিফ। হামলার সময় মেরুন রঙের টিশার্ট পরা এক ব্যক্তিও উপর্যুপরি লাঠি চালায়। যার ভিডিও রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তখন প্রশ্ন ওঠে কে সেই লাল টিশার্ট পরিহিত ব্যক্তি? লাঠি হাতে লাল টিশার্ট পরিহিত ব্যক্তিটিকে অনেকে বলেছেন পল্টন থানার অফিসার ইনচার্জের (ওসি) ড্রাইভার। তবে যোগাযোগ করা হলে পল্টন থানার ওসি এ বিষয়ে এখনো কিছু জানাননি। পুলিশ বলছে, টিশার্ট পরিহিত ব্যক্তি পুলিশ সদস্য। তিনি কনস্টেবল পদে কর্মরত। এ নিয়ে বিস্তারিত জানাবে পুলিশ। এদিকে হামলার ঘটনায় জড়িত মেরুন রঙের টি-শার্ট পরা যুবক ডিবির কেউ নয় বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম। এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ঘটনাটি তদন্ত করে দেখছি।

জরুরি বৈঠকে পুলিশ কর্মকর্তারা: রাজধানীর বিজয়নগরে সেনাবাহিনী ও পুলিশের কতিপয় সদস্যের পিটুনিতে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেশ সমালোচনার মুখে পড়েছে। ঘটনার সময় সেনাবাহিনী ও পুলিশের সামনে লাল শার্ট পরা এক ব্যক্তিকেও লাঠিপেটা করতে দেখা যায়। ওই ব্যক্তি নিজেকে পুলিশ সদস্য দাবি করলেও তার নাম-পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। সার্বিক পরিস্থিতিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গতকাল জরুরি বৈঠকে বসেছেন। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) নজরুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠক চলছে। পুলিশ পরিচয়ে যে ব্যক্তি মারধর করেন তাকে পুলিশ আটক করেছে কি না কিংবা তার নাম পরিচয় জানা গেছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। তার নাম-পরিচয় বা ওই ঘটনা সম্পর্কে এখনই কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।

মব থামাতে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয় সেনাবাহিনী: পুলিশ ‘সহযোগিতা’ চাওয়ায় জাতীয় পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের সংঘর্ষের ঘটনায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা সম্পৃক্ত হন বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর-আইএসপিআর। আইএসপিআর বলছে, ‘শান্তিপূর্ণ সমাধানের সব চেষ্টা অগ্রাহ্য’ হওয়ার পর সেনাবাহিনী সেখানে ‘মব ভায়োলেন্স’ ঠেকানোর জন্য বল প্রয়োগে বাধ্য হয়। শুক্রবার রাতের ঘটনায় সেনাবাহিনীর পাঁচ সদস্যের আহত হওয়ার তথ্যও দিয়েছে আইএসপিআর। আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাত ৮ টার দিকে কাকরাইলে দুটি রাজনৈতিক দলের সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় বেশ কয়েকজন আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়। প্রথমে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। তবে একপর্যায়ে সংঘর্ষ বেড়ে গেলে তারা সেনাবাহিনীর সহযোগিতা কামনা করে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয় এবং এতে কয়েকজন সদস্য আহত হন। আইএসপিআর বলছে, ঘটনার শুরুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উভয় পক্ষকে শান্ত থাকতে এবং নিজেদের মতপার্থক্য দূর করার অনুরোধ জানায়। কিন্তু অনুরোধ সত্ত্বেও কিছু নেতাকর্মী মব ভায়োলেন্সের মাধ্যমে পরিস্থিতি অশান্ত করার চেষ্টা করে। তারা সংগঠিতভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় এবং আনুমানিক রাত ৯টার দিকে মশাল মিছিলের মাধ্যমে সহিংসতা আরও বৃদ্ধি করে। এ সময় তারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে এবং বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন দেওয়ারও চেষ্টা চালায়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিজয়নগর, নয়াপল্টন ও আশপাশের এলাকায় সাধারণ জনগণের চলাচল মারাত্মক ব্যাহত হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শান্তিপূর্ণ সমাধানের সব চেষ্টা তারা অগ্রাহ্য করে। ফলে জননিরাপত্তা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বল প্রয়োগে বাধ্য হয়। আইএসপিআর বলছে, সব ধরনের মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সরকারের এ সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করছে এবং জনমনে স্বস্তি ও নিরাপত্তা আনতে সব ধরনের মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে প্রস্তুত রয়েছে। জননিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা ও শান্তি বজায়ে সেনাবাহিনী সর্বদা বদ্ধপরিকর।

উল্লেখ্য, রাজধানীর কাকরাইলে শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতীয় পার্টি (জাপা) ও গণঅধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। জাপার কার্যালয়ের সামনে দিয়ে গণ অধিকার পরিষদের একটি মিছিল যাওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে। পরে দু’পক্ষকে ছত্রভঙ্গ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাঠিচার্জে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর ও সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খাঁনসহ অন্তত ৫০ জন আহত হন। গুরুতর আহত নুরকে প্রথমে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে চিকিৎসকদের পরামর্শে রাত ১১টার দিকে তাকে ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে স্থানান্তর করা হয়। রাত পৌনে একটার দিকে গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে তিনি জানান, নুরুল হকের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কেন এই হামলার ঘটনা, কে নির্দেশ দিয়েছে, তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানকে স্পষ্ট করতে হবে। নুরুল হকসহ তাঁদের ওপর যে হামলা হয়েছে, এ হামলার জন্য সরকারের কোনো নির্দেশনা ছিল কি না, তা জানাতে হবে। রাশেদ খান বলেন, নুরুল হকের ওপর যেভাবে হামলা হয়েছে, এটা আওয়ামী লীগের আমলেও কোনো নেতার ওপর হয়েছে বলে জানা নেই। সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী এভাবে একসঙ্গে অতীতে হামলা করেছে কি না, জানা নেই।

এদকে ঢাকায় কাকরাইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লাঠিপেটায় গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরসহ নেতাকর্মীরা আহত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করা হয়েছে। এসব কর্মসূচি থেকে হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা এবং জাতীয় পার্টিকে (জাপা) নিষিদ্ধের দাবি জানানো হয়েছে।