তৎপর বিজিবি-পুলিশ, দুই দিনে দেড় শতাধিক আটক

কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলার জেরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে হামলা পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছে। দেশ দু‘টির মধ্যে উত্তেজনার সুযোগে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বাংলাদেশ সীমান্তে নজরদারি জোরদার করেছে। শুধু তাই নয়, বাংলদেশের কয়েকটি সীমান্ত দিয়ে ইতোমধ্যে দেড় শতাধিক ভারতীয় নাগরিককে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করিয়েছে বিএসএফ। এর মধ্যে কিছু আছে রোহিঙ্গা। এছাড়া অধিকাংশই ভারতের গুজরাটের বাসিন্দা বলে জানা গেছে।

তবে চলমান উত্তেজনার মধ্যে দেশের বিভিন্ন সীমান্তে নজরদারি জোরদার করেছে বর্ডারগার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও পুলিশ। স্থানীয়দের সাথে নিয়ে বিজিবির সদস্যরা অবৈধ পুশ ইন ঠেকাতে টহল জোরদার করেছে বলে বিজিবির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। ইতিমধ্যে অবৈধভাবে প্রবেশকারীদের আটক করে কয়েকটি ক্যাম্পে রেখেছে বিজিবি। সীমান্ত জেলার পুলিশও টহল জোরদার করেছে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তান সংঘাতকে কেন্দ্র করে কোনো জঙ্গী বা সন্ত্রাসী যেন দেশে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বাংলাদেশের সীমান্ত জেলাগুলোর পুলিশ সুপারদের সতর্ক করা হয়েছে। বুধবার বিকেলে ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। আইজিপি বলেন, ভারত-পাকিস্তান সংঘাতকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা যেন বিঘ্নিত না হয়, কোনো জঙ্গী বা সন্ত্রাসী যেন দেশে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সীমান্ত জেলাগুলোর পুলিশ সুপারদের সতর্ক করা হয়েছে। এদিকে দুই দেশের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ঢাকা। পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার ভারত ও পাকিস্তান পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং উভয়পক্ষকে শান্ত থাকার পাশাপাশি সংযম দেখানোর অনুরোধ করছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, আঞ্চলিক শান্তি, সমৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতার চেতনায় বাংলাদেশ আশাবাদী যে, কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে উত্তেজনা কমবে এবং এ অঞ্চলের মানুষের জন্য শেষপর্যন্ত শান্তি আসবে। অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান বলেছেন, ‘ভারত থেকে এভাবে পুশ-ইন করাটা সঠিক প্রক্রিয়া নয়। আমরা এরই মধ্যে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি।’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে খলিলুর রহমান এ মন্তব্য করেন। খাগড়াছড়ি ও কুড়িগ্রাম জেলা সীমান্তে ভারত থেকে নাগরিকদের পুশ-ইন করার বিষয়ে জানতে চাইলে খলিলুর রহমান বলেন, আমরা প্রতিটি কেস আলাদা আলাদাভাবে নিরীক্ষণ করছি। আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আমাদের দেশের নাগরিক যদি কেউ হয়ে থাকেন, আর সেটা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তাদের আমরা গ্রহণ করব। তবে এটা ফরমাল চ্যানেলে হতে হবে। এভাবে পুশ-ইন করাটা সঠিক প্রক্রিয়া নয়।

জানা গেছে, মঙ্গলবার রাতে ভারত-পাকিস্তান হামলা শুরুর আগে থেকেই বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে বিভিন্ন এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করে ভারত। এর অংশ হিসেবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি করছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ সীমান্তে নজরদারি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি তৎপর বিএসএফ। বিএসএফ আন্তর্জাতিক সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় নজরদারি বৃদ্ধি এবং যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা রোধে বিএসএফের টহল বাড়িয়েছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ভারতীয় সীমান্তে দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ভূপ্রকৃতিগত চ্যালেঞ্জের মুখে এই নতুন ইউনিট ও কমান্ড হেডকোয়ার্টার বিএসএফের সক্ষমতা ও কৌশলগত অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন সহ্য করতে না পেরে ভারত বাংলাদেশের ওপর যেন আরো প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছে। গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় লালমনিরহাট সীমান্ত পথে গবাদিপশু পাচার, আত্মীয়র সঙ্গে দেখা বা ভালো কাজের খোঁজে দুই দেশের মানুষ সীমান্ত পারাপার করে থাকে। লালমনিরহাট পাটগ্রাম দহগ্রাম সীমান্তের জুলফিকার, তসর উদ্দিনসহ অনেকেই বলেন, সম্প্রতি বিএসএফের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে কাঁটাতারার বেড়া সংলগ্ন এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ বিষয়ে বিজিবি লালমনিরহাট ১৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মেহেদি ইমরান বলেছেন, সীমান্তে বিজিবি টহল জোরদার করা হয়েছে। আর সীমান্তের ওপারে ভারতের অভ্যন্তরে নতুন ব্যাটালিয়ন গঠনের বিষয়ে এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে মন্তব্য করেন তিনি। বিজিবির দেয়া তথ্য মতে, সাতক্ষীরায় ৩৬ কিলোমিটার ডাঙ্গা, আর বাকি ১৬৭ কিলোমিটার নদী সীমান্ত রয়েছে। এই সীমান্ত রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে সাতক্ষীরার ৩৩ ব্যাটালিয়ন রয়েছে। সীমান্তবাসী জানিয়েছেন, এখনও সাতক্ষীরার সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। বিএসএফের অপতৎপরতায় কোনো প্রকার অনুপ্রবেশ বা চোরাচালান বিজিবির কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিহত করতে প্রস্তুত এলাকাবাসী।

বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের দায়ে মঙ্গলবার রাত ও বুধবার সকালে কুড়িগ্রাম জেলা থেকে ৪৪ জনকে এবং খাগড়াছড়ির তিনটি সীমান্ত থেকে ৮১ জনকে পুশ-ইন করা হয়। অপরদিকে জেলার ভূরুঙ্গামারীর ভাওয়ালকুড়ি সীমান্ত পথে ভারতে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকা নারী শিশুসহ ১৪ রোহিঙ্গা নাগরিককে আটক করেছে বিজিবি। এরা সবাই কক্সবাজার উখিয়া ক্যাম্প থেকে দালালদের সহায়তায় ভূরুঙ্গামারীর ভাওয়াল কুড়ি বাজারের কাছে জড়ো হয়েছিলেন। এদিকে জামালপুর বিজিবি ৩৫ ব্যাটালিয়নের রৌমারী ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার সোহেল রানা রোহিঙ্গাসহ ৩০ জনকে আটকের বিষয় নিশ্চিত করেছেন। আটক ব্যক্তিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানান, পাঁচ বছর ধরে তারা ভারতের আসামে বসবাস করছেন। হঠাৎ পুলিশ তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়ে হেলিকপ্টারে করে ত্রিপুরার মানিক ভান্ডার এলাকায় নিয়ে এসে বিএসএফের হাতে তুলে দেয়। তাদের বাড়ি নড়াইল, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় বলে দাবি করেছেন। এছাড়া মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের ধলই সীমান্ত দিয়ে ১৫ জনকে ‘পুশ-ইন’ করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। বুধবার সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে প্রবেশ করায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তাদের আটক করে। জানা গেছে, আটক ব্যক্তিদের মধ্যে ৯ জন পুরুষ, তিনজন নারী ও তিনটি শিশু রয়েছে।

এ ব্যাপারে ৪৬ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. জাকারিয়া বলেন, আটক ব্যক্তিরা সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলছেন। যাচাই-বাছাই করে তাদের বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ঘটনার পর মৌলভীবাজার জেলার সব সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পানছড়ি ব্যাটালিয়ন ৩ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সূত্র বলেছে, সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারিসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সতর্ক আছেন বিজিবি সদস্যরা। তবে পুশ-ইনের বিষয়ে বিজিবির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। রামগড় ৪৩ বিজিবির সহকারী পরিচালক রাজু আহমেদ বলেন, রামগড় সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করা একজনকে আটক করে থানায় সোপর্দ করা হয়েছে।