রমযান ও ঈদকে কেন্দ্র করে বরাবরই কমবেশি আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। অপরাধীরা এসময় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বিশেষ করে মৌসুমী অপরাধীরা বেশ তৎপর হয় ঈদকে সামনে রেখে। ঈদের বাজারে বড় বড় শপিং মল, বিপণি বিতানসহ ব্যস্ততম মার্কেট ঘিরে তৎপর হয় অজ্ঞান ও মলম পার্টি। ছিনতাইকারী, পকেটমার ও থুথুপার্টির সদস্যরা টার্গেট করে মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নেয়। চাদাবাজিতে নামে নানা নামের সন্ত্রাসী বাহিনী। এসময় ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন কিংবা বড় অংকের টাকা পরিবহনেও বাড়ে ঝুঁকি। গুলী করে ছিনতাই ও ডাকাতির মতো দুর্ধর্ষ ঘটনা কম বেশি হয়েছে অতীতের ঈদ উৎসবকে ঘিরে।
তবে এ বছর ছিল ব্যতিক্রম। সাধারণ মানুষ ও অভিজ্ঞজনের মতে, এবার অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল স্বাভাবিক। ঈদ বাজারে কেনাকাটাসহ নিয়মিত কর্মকান্ডে মানুষ কিছুটা হলেও ছিল স্বস্তিÍতে। অনেকেই বলেন, রমযান ও ঈদকে ঘিরে ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যাকান্ড ও লুটতরাজবিহীন এমন স্বাভাবিক পরিস্থিতি কখনো দেখিনি। আসন্ন ঈদুল ফিতর ২৯ রমযান ধরে হিসেব করলে বাকি আর মাত্র দুই দিন। পুরো রমযান মাস জুড়ে আইনশৃঙ্খলা ভালো থাকলেও শেষের দিকে এসে রাজধানীতে র্যাব-পুলিশ পরিচয়ে একটি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। টার্মিনালগুলোকে ঘিরে ভ্রাম্যমান অপরাধীদের তৎপরতাও এবার চোখে পড়ছে না। মানুষ নির্বিঘ্নে যে যার গন্তব্যে পৌঁছতে পারছেন। কিন্তু পুরো রমযান ও ঈদকে ঘিরে এবারের আইনশৃঙ্খলা ভালো থাকার কারণ সম্পর্কে র্যাব ও পুলিশ বলছে-মানুষের সচেতনতা এবং পুলিশের ব্যাপক প্রস্তুতি থাকার কথা। ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙঙ্খলার কিছুটা অবনতি ঘটেছিল। অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল পুলিশ বাহিনী। পুলিশের চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ার আগেই এ বাহিনীকে নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়েছে। ফলে পুলিশের মাঝে এখন আর কোনো হীনমন্যতা নেই বললেই চলে।
জানতে চাইলে গতকাল শুক্রবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, রমযানের শুরু থেকেই আমরা চেক পোস্ট, টহল কার্যক্রম বৃদ্ধি এবং গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে রেখেছিলাম। এর বাইরে অপরাধীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। তিনি বলেন, সার্বিকভাবে আমাদের তরফ থেকে যেসব ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন বলে মনে হয়েছিল সেগুলো আমরা করেছি। তিনি বলেন, পুুলিশের সাথে অন্যান্য সংস্থার সাথে বৈঠক করেছি, তাদের মতামত নিয়েছি। ব্যবসায়ীদের সাথে একাধিক বৈঠক করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার ব্যাপারে মতামত নিয়ে সে অনুযায়ী কাজ করেছি। ডিসি তালেবুর রহমান বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় অক্সিলারি ফোর্স হিসেবে যারা ছিল এরকম আগেও ছিল তবে কার্যকর ছিল না। এটা এবার প্রথমবারের মতো আমরা চালু করেছি। এতে আমরা অনেকটাই সফলতা পেয়েছি। তিনি জানান, এরমাঝে আইনশৃঙ্খরা বাহিনীর পরিচয়ে যে একটা ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে এটা অপরাধীদের একটা কৌশল। তিনি বলেন, এ ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে আমরা অধিকাংশকেই ইতোমধ্যে ধরে ফেলেছি। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ঢাকায় বড় ধরণের কোনো অপরাধের খবর আমাদের কাছে আসেনি। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি মানুষকে সচেতন করার। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ছিল তৎপর। তিনি বলেন, জনগণ আমাদের সাথে ছিল, আমাদের সাথে আছে এবং তাদের সহায়তায় আইনশৃঙ্খলা ভালো ছিল এটা বলা যায়। তিনি বলেন, সোস্যাল মিডিয়াতে কিছু মানুষ আগে থেকেই অপতপরতা চালিয়েছিল তবে বাস্তবে পরিস্থিতি ভালো ছিল।
ঈদের ছুটিতে ৯ দিনের প্রস্তুতি: ছুটিতে রাজধানীতে বিশেষ নিরাপত্তা পরিকল্পনা সাজিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যাব। পুলিশ জানিয়েছে, চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে এ সময় মহানগরে অন্তত ১৫ হাজার পুলিশ তৎপর থাকবে। রাস্তায় তল্লাশি চৌকি বসানোর পাশাপাশি বিপণিবিতান ও আবাসিক এলাকায় টহল জোরদার করা হবে। ডিএমপি সূত্র জানায়, ঈদ ঘিরে অনেক মানুষ ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন। এতে বাসা-বাড়ি, ফ্ল্যাট ও অফিস ফাঁকা হয়ে যাবে। ফাঁকা ঢাকায় অপরাধ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে নগরবাসী। চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি- এই ভয়ের অন্যতম কারণ। এসব বিষয় মাথায় রেখে ঈদের আগে ও পরে নিরাপত্তা পরিকল্পনা সাজিয়েছে ডিএমপি। ডিএমপির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ঈদে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ ঠেকাতে রাতের বেলায় বাড়ানো হবে পুলিশি টহল। নিরাপত্তা জোরদার করা হবে বাস টার্মিনাল, লঞ্চ ও রেলস্টেশনে। পুরান ঢাকা ছাড়াও মহানগরের বিভিন্ন এলাকার সোনার মার্কেটে থাকবে পুলিশের কড়া নজরদারি। বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে। ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশ রাজধানীতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি প্রতিরোধে পুলিশি টহল ও চেকপোস্ট বৃদ্ধি করেছে। ঈদের সময় রাজধানীতে দিনে-রাতে ৬০০টি পুলিশ দল টহল দেবে। এ ছাড়া প্রতিদিন মহানগরের ৭৫টি তল্লাশি চৌকি পরিচালনা করা হবে। র্যাবের পক্ষ থেকেও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান গতকাল শুক্রবার দৈনিক সংগ্রামকে জানান, ঈদে মানুষের নিরাপত্তায় গোয়েন্দা কার্যক্রম ও টহল জোরদার করা হয়েছে। এ সময় ইউনিফর্মের পাশাপাশি সাদা পোশাকে র্যাব গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরা তৎপর থাকবেন। তিনি বলেন, ঈদে নিরাপত্তায় গোয়েন্দা, ফুট পেট্রল, মোবাইল পেট্রল, সাইবার ওয়ার্ল্ডের নজরদারি থাকবে। ঢাকায় ১০০টি এবং ঢাকার বাইরে ২৫২টিসহ মোট ৩৫২টি টিম ঈদের ছুটিতে ৯ দিন ধরে কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। তিনি বলেন, আমাদের ব্যাপক প্রস্তুতি আছে। এছাড়াও সাধারণ মানুষের সহায়তায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সক্ষম হয়েছি। তিনি বলেন, সবাই মিলে চেষ্টা করলে আমাদের এই দেশকে নিরাপদ রাখা সম্ভব।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, ঈদকে সামনে রেখে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট হাইওয়ে পুলিশ, শিল্প পুলিশ ও রেলওয়ে পুলিশকে বিশেষভাবে সক্রিয় করা হয়েছে। সারাদেশেই গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। মহাসড়কে ডাকাতি রোধে বিশেষভাবে নজর দেওয়া হচ্ছে। আর চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই প্রতিরোধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যাত্রী ও জনগণকে সতর্ক করা হচ্ছে। একই সঙ্গে এই সময়ে প্রতারক চক্র অনেক বেশি সক্রিয় হয়। সেদিকেও বিশেষ নজর রয়েছে পুলিশের। তিনি বলেন, মানুষ এবার নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছতে পেরেছে এটাই সবচেয়ে আনন্দের।
অক্সিলারি ফোর্সে ৪২৬ জনকে নিয়োগ: ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ঈদের ছুটিতেও নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকবে রাজধানী। তিনি বলেন, এবারের দীর্ঘ ছুটিতে মানুষ গ্রামে চলে যাচ্ছে। এসময় ফাঁকা রাজধানীতে অপরাধীরা যাতে সুযোগ না পায় সেজন্য ছুটির পর সাত দিন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকবে। পুলিশকে সহায়তা করার জন্য ‘অক্সিলারি ফোর্স’ হিসেবে ইতোমধ্যে ৪২৬ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন আবাসিক এলাকা, বিপণিবিতান ও বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে কাজও শুরু করেছেন। নগরীর নিরাপত্তায় থাকা পুলিশ সদস্যদের তারা সহযোগিতা করবেন। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিক সম্মেলনে ডিসি মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেছিলেন, ধানমন্ডিতে এক জুয়েলারি ব্যবসায়ীর বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা প্রতিরোধে এগিয়ে আসা পাঁচ নির্মাণশ্রমিককে ‘অক্সিলারি ফোর্সে’ নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ডিসি মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, তাদেরকে আমরা ‘অক্সিলারি ফোর্সে’ যুক্ত করে নেব।
এর আগে ৮ মার্চ রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছিলেন, রমযানে অনেক রাত পর্যন্ত শপিং সেন্টারগুলো খোলা থাকবে। বিভিন্ন শপিংমল, শপিং সেন্টার ও গেট দিয়ে ঘেরা বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় মেট্রোপলিটন পুলিশ আইন বলে অক্সিলারি পুলিশ ফোর্স নিয়োগ ক্ষমতা আমার আছে। সেই ক্ষমতা মোতাবেক আমি বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীদের অক্সিলারি পুলিশ ফোর্স হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছি। তাদের হাতে একটি ব্যান্ড থাকবে। সেখানে লেখা থাকবে সহায়ক পুলিশ কর্মকর্তা। সেদিন তিনি আরো বলেছিলেন, আইন মোতাবেক পুলিশের মতোই এসব সহায়ক পুলিশ দায়িত্ব পালন ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবেন। পুলিশ অফিসার আইনগতভাবে যে প্রটেকশন পান এই অক্সিলারি ফোর্সের সদস্যরাও একই প্রটেকশন পাবেন।
পুলিশি তৎপরতায় ছিনতাই-চাঁদাবাজি কমেছে: গত সোমবার সকালে ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্সের সম্মেলন কক্ষে এক সমন্বয় সভায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের জোর তৎপরতায় রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকটাই উন্নত হয়েছে। এদিন আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতর-২০২৫ উদযাপন উপলক্ষে ঢাকা মহানগরীর সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা, যাত্রী সাধারণের যাতায়াত নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন রাখা, ঈদের জামায়াত সুষ্ঠুভাবে আদায় ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতির বক্তব্যে ডিএমপি কমিশনার বলেন, পবিত্র ঈদুল ফিতর উৎসবমুখর ও নিরাপদ পরিবেশে উদযাপনের লক্ষ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সকল ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। পুলিশের গৃহীত পদক্ষেপের পাশাপাশি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পর্যায়েও নিরাপত্তা সচেতনতাবোধ তৈরি হতে হবে। তিনি বলেন, যেকোনো আইনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটা প্রভাব তৈরি করা যেন মানুষ বুঝতে পারে যে আইন লঙ্ঘন করলেই শাস্তির সম্মূখীন হতে হবে। সড়কে কেউ যদি উল্টা পথে গাড়ি চালায় কিংবা ফুটপাত দিয়ে মোটরসাইকেল চালায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের জোর তৎপরতায় রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকটাই উন্নত হয়েছে। পুলিশি তৎপরতায় ছিনতাই ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনা অনেকাংশে কমে গেছে। সবার সহযোগিতা নিয়ে আমাদেরকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।