দেশে এখনো ফ্যাসিবাদের কারখানা রয়ে গেছে। যারা শহীদ রয়েছেন, সেই শহীদ খুনীদের কোনো বিচার হয়নি। রক্ত দেয়া হয়েছে সংস্কার এবং নতুন একটি সংবিধানের জন্য। সেগুলোও হয়নি। অতীতের ধারাবাহিকতায় পুরনো পদ্ধতির নির্বাচনে যদি একই ফ্যাসিবাদী সিস্টেম ফিরে আসে, তাহলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। গতকাল মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে (কেআইবি) জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুব উইং জাতীয় যুবশক্তি আয়োজিত সম্মেলনে বক্তারা একথা বলেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রে ছাড় দিয়েছি, জুলাই সনদে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। এক পার্সেন্টও ছাড় দেওয়া হবে না। যে মৌলিক সংস্কার এবং বন্দোবস্তের কথা আমরা বলেছি, সেই জুলাই সনদে আমরা এক বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেবো না। তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থানের প্রতিশ্রুতি (জুলাই সনদ) আদায় না করে সরকার যেতে পারবে না। প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসতে পারবে না।

সাবেক তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, নির্বাচন, ভোটাধিকার, গণতন্ত্রের জন্য আমাদের লড়াই ছিল। আমাদের এই মুহূর্তের বড় সংকট হলো স্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক ঐক্য ধরে রাখা। যদি রাজনৈতিক দলের ছাড় দেওয়ার মানসিকতা না থাকে তাহলে আরেকটা এক-এগারো আসবে।

তিনি বলেন, ছাড় দিতে দিতে আমরা শেষ পর্যায়ে এসেছি। আমরা এবার আর ছাড় দেবো না। গণঅভ্যুত্থানের প্রতিশ্রুতি (জুলাই সনদ) আদায় না করে সরকার যেতে পারবে না। প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসতে পারবে না।

এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, একাত্তরের পরে কীভাবে রক্ষীবাহিনী দিয়ে, বাকশাল তৈরি করে কীভাবে লুটপাট করা হয়েছিল। ৯০-এর পরেও কী হয়েছিল তা আমরা দেখেছি। ২৪-এর অভ্যুত্থানের পর সেই ভুল হতে দেবো না। সমীকরণ এখনো শেষ হয়নি, যারা সমীকরণ মিলিয়ে ফেলছেন তারা ভুল করছেন। তিনি আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পার হয়েছে, ফলে অনেক ধরনের হিসাব-নিকাশ আমরা করছি। এক বছর আমরা কী পেলাম, তরুণরা কী পেলো, দেশে কী কী পরিবর্তন হলো? গণঅভ্যুত্থানের এক বছরেও নতুন বাংলাদেশ আমরা পাইনি।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও দেশে কেন দিল্লি-পিন্ডির স্লোগান দিতে হচ্ছে- এমন প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, আমরা নেতারা মনে করি ক্ষমতায় আসতে হলে অন্যদের সহযোগিতা লাগবে। বিদেশি কোনো শক্তির সহায়তা লাগবে। জুলাইয়ে যুবকরা প্রমাণ করেছে আমাদের শক্তি সবচেয়ে বড় শক্তি। আমরা লড়াই করতে জানি, ঐক্যবদ্ধ হতে জানি, জীবন দিতে জানি। শুধু পরাজয় জানি না।

যুব সম্মেলনে ডা. তাহের বলেন, জাতিসত্তার স্পন্দিত হৃদয়ের নাম হচ্ছে যুবক। আজ বাংলাদেশের স্পন্দিত একটি অংশই সম্মেলন উপস্থিত হয়েছে। স্লোগান দেওয়া হচ্ছে- আমরা দিল্লি নই, আমরা পিন্ডি নই, আমরা বাংলাদেশ। তিনি বলেন, ৫৪ বছর পরও স্বাধীন দেশে কেন দিল্লি-পিন্ডির স্লোগান দিতে হচ্ছে আমার বাংলাদেশে? এজন্য আমি মনে করি না আমাদের মধ্যে কোনো আইডেনটিটি ক্রাইসিস আছে, তবে আমাদের মধ্যে হীনমন্যতা আছে। এই হীনমন্যতা বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলে দিতে হবে।

নতুন বয়ানে গণঅভ্যুত্থানের নেতাদের খলনায়ক বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে মন্তব্য করে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, গণঅভ্যুত্থানের শক্তির মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। একজনকে আরেকজনের পক্ষে-বিপক্ষে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, নতুন বয়ান তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। নতুন বয়ানে গণঅভ্যুত্থানের নেতাদের খলনায়ক করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই বয়ান হচ্ছে নতুন বাংলাদেশকে দিল্লির হাতে তুলে দেওয়ার বয়ান। এই রাজনীতি থেকে তরুণ এবং যুবকদের সাবধান হতে হবে।

তিনি বলেন, রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র তৈরি হয় শত্রু সাপেক্ষে, আমার দেশ কীভাবে নিরাপদ রাখা যায় সেই সাপেক্ষে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মুক্তির লড়াই, আত্মমর্যাদার সাপেক্ষে। সে লড়াইয়ে তরুণদের, যুবকদের বুঝতে হবে এই লড়াইয়ে কারা আমাদের শত্রু। কারা আমাদের সময়ের ঘসেটি বেগম এবং কারা মীর জাফর। কারা সীমান্ত বিক্রি করে দিচ্ছে, কারা আমার দেশের স্বার্থ বিক্রি করে দিয়েছে।

অতিথির বক্তব্যে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেন, জুলাই আন্দোলনের সময় ডিবি অফিসে সারজিস-হাসনাতের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সেদিন তাদের শুধু একটা কথা বলেছিলাম, আমি যেদিন ছাত্রদলের প্রেসিডেন্ট ছিলাম শেখ হাসিনা আমাকে আটকে রাখতে পারেনি। আজও শেখ হাসিনা তোমাদের আটকে রাখতে পারবে না।

এ্যানি বলেন, জুলাই আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে ফ্যাসিবাদের কবর দিতে হয়। ৩৬ জুলাই শিখিয়েছে কীভাবে শেখ হাসিনাকে বিদায় দিতে হয়। জুলাই আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে আয়নাঘর ধ্বংস করতে হয়। তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্যের বিকল্প নেই। সেটি হতে হবে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়। যাকে ভাঙা যাবে না, মচকানো যাবে না। লোভের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের প্রয়োজনে আমরা এগিয়ে যেতে চাই।

এনসিপি দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন,গত এক বছরে প্রশাসনের চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। আসন্ন নির্বাচনের আগে প্রশাসনের সংস্কার এবং তাদের নিরপেক্ষ ভূমিকায় দেখতে চাই। একইসঙ্গে হাসিনার আমলের বিগত নির্বাচনে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর হয়ে গেছে, গত এক বছরে সরকার কী কী করেছে এটি প্রকাশ করতে হবে। পরে সরকারে কী কী পরিকল্পনা রয়েছে সেগুলো পরিষ্কার করতে হবে।

হাসনাত আবদুল্লাহ দেশের মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, পৃথিবীতে আর কোনো দেশে এই ধরনের মিডিয়া আছে কি না, সেটা প্রশ্নবিদ্ধ। যেখানে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ডিজিএফআই নিউজ লিখে পাঠায় এবং মিডিয়া তা প্রকাশ করে। তিনি বলেন, মিডিয়ায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন এজেন্সি নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করে। এজেন্সি ছবি তুলে পাঠায়, সেটা মিডিয়া প্রকাশ করে। ফলে মিডিয়া এখন জনগণের কণ্ঠস্বর না হয়ে বিভিন্ন এজেন্সির মুখপত্র হিসেবে কাজ করছে।

এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে। নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হবে না। যদি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হয় তাহলে আমার যেই ভাইয়েরা শহীদ হয়েছিল, সংস্কারের জন্য একটি নতুন সংবিধানের জন্য রক্ত দিয়েছিল সেই মরদেহটা সরকারের ফেরত দিতে হবে। তিনি বলেন, একই সংবিধানে একই ফ্যাসিবাদী সিস্টেমে নির্বাচনে যাচ্ছি। তাহলে এতগুলো মানুষের শহীদ হওয়ার দরকার কি ছিল।

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা বলেন, তরুণদের মধ্যে জোয়ার এসেছে। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হয়েছে। তারা দেশ নিয়ে স্বপ্নের কথা বলেছেন, রাজনীতি নিয়ে সম্ভাবনার কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হয়েছে, এটাকে আমাদের লালন করতে হবে। যারা রাজনৈতিক দলের নেতারা আছেন, আমরা আশা করব তারা এটিকে লালন করবেন। তিনি বলেন, গত এক বছর ধরে তরুণদেরকে বিভিন্নভাবে হেও প্রতিপন্ন করা হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনে তরুণরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। তরুণদেরকে হেয় করে দেখা, ছোট করে দেখার সংস্কৃতি থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে।

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেছেন, ইদানিং মিডিয়া প্রেজেন্স দেখেন, টকশো গুলো দেখেন। দেখবেন খুব স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগকে প্রাসঙ্গিক করার, ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। ফ্যাসিবাদকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এই ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে। এটি শুধু এনসিপি এবং যুব শক্তির কাজ নয়, যুবকদের এই দায়িত্ব নিতে হবে। রাজনৈতিক পক্ষকে নতুন করে ভাবতে হবে, তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করবেন নাকি নতুন রাজনীতি করবেন। মিডিয়া এস্টাবলিশমেন্ট, আমলা এস্টাবলিশমেন্ট, আর্মি এস্টাবলিশমেন্ট রুখে দিয়ে ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা হবে।

এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান থেকে মুক্তি দিয়েছে। আমরা যুবকরা দিল্লি থেকে মুক্তি দিয়েছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষয়ী বিপ্লব ঘটিয়েছে আমাদের যুবকরা। সবাই এক কথায় রাজপথে এসেছিল, উদ্দেশ্য একটাই এই দেশকে দিল্লির দাসত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া। তিনি বলেন, যারা আমাদের বাচ্চা ছেলে মনে করে, তারা বলে বাচ্চাদের কাছে বাংলাদেশ নিরাপদ না। বাচ্চারা বুক পেতে শহীদ হয়ে আপনার জন্য নিরাপদ বাংলাদেশ উপহার দিয়েছে।