দাবি আদায়ের নামে পাবনা রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে বড় ধরনের বিশৃংঙ্খলার চেষ্টা চলছে। আন্তর্জাতিক স্পর্শকাতর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে রূপপুর প্রকল্প সার্বক্ষণিক আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার নজরদারিতে থাকে। এমন একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দাবি আদায়ের নামে চলছে নানা কা-। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের ২৬ জন কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্তের ঘটনা ঘটেছে। একইসঙ্গে ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ তাদের রূপপুর প্রকল্প ও গ্রিন সিটি বহুতল আবাসিক এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করে পৃথক চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সরকারকে বেকাদায় ফেলা এবং স্পর্শকাতর বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঝুঁকিতে ফেলার অভিযোগ তুলেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ও এলাকাবাসী।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক স্পর্শকাতক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে রূপপুর প্রকল্প সার্বক্ষণিক আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার নজরদারিতে থাকে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে আন্দোলন, সমাবেশ বিশ্বে নজিরবিহীন। প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তার শর্ত ভেঙে মিছিল-সমাবেশ করে আন্দোলনকারীরা। তারা শুধু চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজই করেননি, প্রকল্পের অগ্রগতি ও পরবর্তী ধাপের লাইসেন্স প্রাপ্তিও হুমকিতে ফেলেছেন। ফলে নীতিগতভাবেই তাদের চাকরিতে বহাল থাকার কোন সুযোগ নেই। তাদের অন্য কোন চক্রান্তে যোগসাজশ আছে কি না- তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, প্রকল্পের কর্মীদের চাকরি সংক্রান্ত অভিযোগ থাকতেই পারে। কিন্তু আন্দোলনকারীদের হঠকারী আচরণে মনে হয়েছে। তারা পরিকল্পিতভাবে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে মাঠে নেমেছে। নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাদের দাবির যৌক্তিকতা বিচার করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা তা শুনতে নারাজ।
সূত্র জানায়, এনপিসিবিএল-এর কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সরকার মালিকানাধীন সকল কোম্পানির চেয়ে বেশী বেতন পেয়ে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, এনপিসিবিএল এ ৭ম গ্রেড এর কর্মকর্তা সিনিয়র এসিটেন্ট ম্যানেজারের মূল বেতন ৭৫ হাজার ৬০০ টাকা। বাড়ি ভাড়া ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ হারে ৩০ হাজার ২৪০ থেকে ৪৫ হাজার ৩৬০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ২ হাজার ৫০০ টাকা, স্পেশাল এলাউন্স ৫ শতাংশ হারে ৩ হাজার ৭৮০ টাকা, ৪০ শতাংশ প্রজেক্ট ভাতা ৩০ হাজার ২৪০ টাকাসহ সাকুল্যে ১ লাখ ৪২ হাজার ৩৬০ টাকা পান। এর সাথে ৪ শতাংশ ইনক্রিমেন্টও পান। একইভাবে অন্যান্য গ্রেডের কর্মকর্তারাও সরকারী অন্যান্য কোম্পানির চেয়ে বেশি বেতন পেয়েও বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি, প্রমোশনসহ নানা দাবিতে আন্দোলন হট্টগোল করেছেন। এমনকি নির্মাণ ও অর্থায়নকারী রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান ও কর্মকৌশল নিয়ে বিরূপ মন্তব্য ও বিষোদগার করেছেন। যা এই প্রকল্পের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
এদিকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের ২৬ কর্তকর্তা কর্মচারীকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ১৩ মে ৮জন এবং ৮ মে ১৮জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ তাদের রূপপুর প্রকল্প ও গ্রিন সিটি বহুতল আবাসিক এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করে পৃথক চিঠি দেওয়া হয়েছে।
১০ মে রাতে চাকরিচ্যুত ১৮ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী ও সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন দের ই-মেইলে এ তথ্য জানানো হয়। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. জাহেদুল হাছান স্বাক্ষরিত এক দাপ্তরিক আদেশে এ অব্যাহতির কথা জানানো হয়।
অব্যাহতি প্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা হলেন- ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট হাসমত আলী (প্রধান কার্যালয়), ঊর্ধ্বতন সহকারী ব্যবস্থাপক শহিদুল ইসলাম, আবু রায়হান, রফিকুল হাসান, আয়নাল হোসেন, নাঈম আল সাকিব, আবু সাঈদ, এ কে এম আব্দুল আল আমিন, শাহ ইখতিয়ার আলম, ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ, সহকারী ব্যবস্থাপক আব্দুল আল নোমান, আসিফ খান, মুহাম্মদ ইমামুল আরেফিন, ইকরাম, রুহুল আমিন, উপসহকারী ব্যবস্থাপক ইসমাইল হোসেন, রুবেল হোসেন এবং টেকনিশিয়ান ফিরোজ আহমেদ। চাকরিচ্যুত ব্যক্তিরা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (এনপিসিবিএল) পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন।
১৩ মে মঙ্গলবার এনপিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রকল্প পরিচালক মো. জাহেদুল হাছানের স্বাক্ষরিত আলাদা চিঠিতে আটজনকে সাময়িক বরখাস্ত ও নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জানানো হয়। বুধবার এ সংক্রান্ত চিঠি দুটি আলাদা ইমেইলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
সাময়িক বরখাস্ত আট কর্মকর্তা-কর্মচারী হলেন এনপিসিবিএলের সহকারী ব্যবস্থাপক ইকতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিপ্লব, শামীম আহম্মেদ, মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, মো. গোলাম আজম, ঊর্ধ্বতন সহকারী ব্যবস্থাপক মো. মনির, ঊর্ধ্বতন উপসহকারী ব্যবস্থাপক গোলাম আজম এবং টেকনিশিয়ান রিয়াজ উদ্দিন ও ইসমাইল হোসেন।
সাময়িক বরখাস্তের নোটিশে উল্লেখ করা হয়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা ও এনপিসিবিএলে তারা শৃঙ্খলাবিরোধী বা নাশকতামূলক কর্মকা-ে লিপ্ত হয়েছেন। কর্তব্যে অবহেলা করেছেন এবং করছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা আগামী ১০ দিনের মধ্যে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
এনপিসিবিএল এর কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহেদুল হাসান প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, সেচ্ছাচারিতা এবং প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেচ্ছাচারি, অনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থের দাপটে আমাদের নিষ্পেষিত করছেন। আমরা প্রধান উপদেষ্ঠা সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।প্রকল্পের কর্মীরা দাবি করছেন, তাদের এ আন্দোলন প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ও কর্মপরিবেশের স্বার্থে। তারা আশা করছেন, কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ নেবে, যাতে প্রতিষ্ঠানটিতে স্বচ্ছতা ও উন্নয়ন সাধিত হয়।
এদিকে পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ‘বন্ধের ষড়যন্ত্রের’ প্রতিবাদে ঈশ্বরদী উপজেলায় মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলার ফকিরের বটতলা এলাকায় ‘সচেতন নাগরিক সমাজ ঈশ্বরদী’র ব্যানারে এ কর্মসূচি পালন করা হয়। বিদ্যুৎ প্রকল্পে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দাবি আদায়ের নামে সেখানে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করে ‘বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টি করে তা বন্ধের পাঁয়তারা করছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
বক্তারা বলেন, দাবি আদায়ের নামে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ‘বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টি করছে একটি গোষ্ঠী; যার কারণে প্রকল্প চালু করে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ঈশ্বরদীবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্নের প্রকল্প বন্ধ করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে রাস্তায় নেমেছেন তারা।
প্রকল্পটির প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। চলতি মাসে গ্রিডের সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ হওয়ার কথা। এরপর ডিসেম্বরে স্টার্ট-আপ করার কথা। এ অবস্থায় প্রকল্প এলাকায় বিক্ষোভ ও সমাবেশ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঘটনা অশুভ সংকেত বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।
দাবি আদায়ের নামে কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে এবং এই প্রকল্পকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে রূপপুর প্রকল্পের নিরাপত্তা বিঘœকারী ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান বক্তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, চরম স্পর্শকাতর ও নিরাপত্তা বেষ্টিত নিউক্লিয়ার প্লান্ট এলাকায় এ ধরনের কর্মসূচি পালনের নজির বিশ্বে কোথাও নেই। এমন চলতে থাকলে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো বিপজ্জনক হয়ে যাবে। সেফটি কালচার, সিকিউরিটি কালচার, কোড অব কন্ট্রাক্ট সবকিছু মেনে চলতে হবে। প্রকল্পে যেসব ঘটনা ঘটছে তা খুবই দুঃখজনক। পারমাণবিক কেন্দ্র শান্তিপূর্ণভাবে চালানোর ক্ষেত্রে এধরনের কর্মকা- অন্তরায়। বিষয়টি সরকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।