বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক কার্ল স্কাউ বলেছেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ১৩ লাখ রোহিঙ্গার জন্য খাদ্য সহায়তা জোগাতে সংস্থাটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকট এখনো রোমভিত্তিক জাতিসংঘ সংস্থাটির শীর্ষ অগ্রাধিকারের একটি ইস্যু। মঙ্গলবার (স্থানীয় সময়) ইতালির রাজধানী রোমে এক হোটেলে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি এ কথা বলেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এ তথ্য জানায়।
বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট, গাজা ও সুদানের দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি এবং বৈশ্বিক ক্ষুধা মোকাবিলায় তহবিল সংগ্রহের ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা হয়। স্কাউ গত ১৫ মাসের অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসা করে বলেন, রোহিঙ্গা মানবিক সংকট বিষয়ে আন্তর্জাতিক মনোযোগ ফেরাতে তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। উভয় নেতা বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিত মানুষের সহায়তায় তহবিল বৃদ্ধির জরুরি প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
স্কাউ ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অধ্যাপক ইউনূসের অনুরোধে অনুষ্ঠিত রোহিঙ্গা ইস্যুতে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে বিষয়টি আন্তর্জাতিক এজেন্ডার শীর্ষে থাকে।’ বৈঠকে নতুন উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহের সম্ভাবনা, বিশেষ করে ধনী দেশ ও বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়ে আলোচনা হয়। স্কাউ জানান, নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ওই উচ্চপর্যায়ের জাতিসংঘ বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নতুন মানবিক সহায়তার অঙ্গীকারের পর ডব্লিউএফপি প্রত্যেক রোহিঙ্গাকে মাসে ১২ ডলার করে খাদ্য ভাতা প্রদান অব্যাহত রাখবে। অধ্যাপক ইউনূস বৈশ্বিক ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় ডব্লিউএফপির নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশের নতুন স্কুল ফিডিং কর্মসূচি বাস্তবায়নে সংস্থাটির সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘কিছু এশীয় দেশ স্কুল ফিডিং কর্মসূচিতে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। আমরাও এ উদ্যোগকে আরও শক্তিশালী করতে চাই, যাতে গুণগত মান নিশ্চিত করে ধীরে ধীরে সম্প্রসারণ করা যায়। বৈঠকে বৈশ্বিক ক্ষুধা পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়। স্কাউ জানান, প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বর্তমানে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। গাজায় শত শত খাদ্যবাহী ট্রাক পাঠাতে ডব্লিউএফপি অব্যাহতভাবে কাজ করছে। বৈঠকে খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ এবং পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম উপস্থিত ছিলেন।
ইতালিতে বাংলাদেশী কমিউনিটি নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাত
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘ইতালির ভাষ্য, কিছু লোকের সমস্যা আছে। ভেজাল, এই বাংলাদেশ যেখানে যাচ্ছে একটা ভেজালের সৃষ্টি করছে। এটা থেকে আমরা বাঁচতে পারছি না। আমি বললাম যে আমরা দুই পক্ষ চেষ্টা করি, আমাদেরও কষ্ট হয়। তারা ঠেকায় পড়ে এসবের মধ্যে পড়ে গেছে, এমন না যে তারা দুষ্ট লোক। তারা ভালো লোক, কিন্তু পরিস্থিতির কারণে দুষ্টুমি করে টিকে থাকতে হয়েছে। দুষ্টুমি করে যাতে টিকতে না হয় সে জন্য একটা পন্থা বের করতে হবে আমাদের। সেটা নিয়ে ইতোমধ্যে আলোচনা হয়েছিল। এখন তারা বলছেন- একজন যদি নিয়ে যাও তাহলে এতজনকে আমরা আনবো। মঙ্গলবার ইতালির রোমে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘একজন ভেজাল লোক... অদলবদল করলে জিনিসটা পরিষ্কার হয়ে যায়। এখন একজনের পরিবর্তে একজন হবে না দুই জন হবে সেটা নিয়ে আলাপ করছি। এটা নিয়ে কী করা যায়, আমরা ভাবছি। এটা থেকে নিষ্কৃতি পেতে হবে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে তাদের এটা করতে হয়। নানাভাবে ইতালি আসে লোকজন, এই যে নানাভাবে যারা আসে তাদের সঙ্গেও আলাপ হয়েছে আমাদের। জাহাজ থেকে সদ্য নামা লোকের সঙ্গে আমার বৈঠক হয়েছে। মেয়র বলছে-কী করবো এরা যখন এসে গেছে! মেয়র বললেন যে এসে যখন গেছে আমরা গ্রহণ করছি। তাদের আচরণ অত্যন্ত মানবিক তারা ফেরত যেতে বলে না। এটাই দেখলাম যে তারা সম্মান করে।
তিনি বলেন, ‘রোমের মেয়রের সঙ্গে আলাপে বলেছেন তিনি বাংলাদেশিদের অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখেন। তার কথায় বাংলাদেশিদের নিয়ে কোনও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য মোটেও ছিল না। অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে বলেছেন যে আপনারা তাদের জন্য মূল্যবান। এই শহরের একটা মূল্যবান অংশ আপনারা, আপনাদের কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে রোম শহরের উন্নতি হচ্ছে বলেও উনি উল্লেখ করেছেন। আপনাদের পরিশ্রম, মেধা, সৃজনশীলতার খুব প্রশংসা করেছেন তিনি। এই প্রশংসা শুধু রোম শহরের জন্য না, পুরো ইতালির জন্য আমি বারবার শুনেছি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস আরও বলেন, ‘ইতালির প্রধানমন্ত্রী মেলোনির সঙ্গে আমার তিনবার দেখা হয়েছে। চতুর্থবার আবার দেখা হবে ডিসেম্বরে, উনি তখন বাংলাদেশে আসবেন। সম্প্রতি জাতিসংঘে মেলোনির সঙ্গে দেখা হয়েছে, সেখানেও একই কথা আপনাদের নিয়ে। আপনাদের সমস্যাগুলো নিয়ে আমি সেখানেও বলেছি। ভিসা নিয়ে বললাম, এই যে বের করে দেওয়া হচ্ছে সেটা নিয়েও বললাম, ভিসা দেওয়া হয়েছিল কিন্তু রিনিউ হচ্ছে না, সেগুলো নিয়েও বললাম। উনিও দুঃখের কথা বললেন, আমরা অত্যন্ত সম্মান করি বাংলাদেশিদের, তারা ইতালির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন যে- আমরা নিষ্কৃতি পেতে চাই না, আমরা তাদের রাখতে চাই, সম্মানের সঙ্গে রাখতে চাই।
এদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মহাপরিচালক ড. কু দোংইউ বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণ শিল্পের উন্নয়ন ও কৃষিজাত পণ্যÑবিশেষ করে ফল রপ্তানি বাড়াতে অব্যাহত সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। রোমে এফএও সদর দপ্তরে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরাম এবং সংস্থাটির ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সোমবার (রোম সময়) প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তিনি এ আশ্বাস দেন।
বৈঠকের শুরুতে ড. কু অধ্যাপক ইউনূসকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান এবং বাংলাদেশের কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নে তাঁর ব্যাপক অবদানের প্রশংসা করেন। বাংলাদেশকে ‘উচ্চ সাফল্য অর্জনকারী দেশ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এফএও মহাপরিচালক বলেন, সংস্থাটি প্রযুক্তিগত সহায়তা, উদ্ভাবন এবং দক্ষিণ-দক্ষিণ ও ত্রিমুখী সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশকে সহায়তা অব্যাহত রাখবে। তিনি বলেন, ‘আমরা আপনাদের সহায়তা অব্যাহত রাখব।
প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস এফএও’র দীর্ঘদিনের সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনটি নতুন ক্ষেত্রে সহায়তা চান-গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণ ও মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণে সক্ষমতা বৃদ্ধি, ফল রপ্তানি সম্প্রসারণে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ উন্নয়ন এবং ফসল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা জোরদার করা, যার মধ্যে সাশ্রয়ী ও বহনযোগ্য কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন অন্তর্ভুক্ত। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমাদের পুরো সমুদ্র রয়েছে, কিন্তু আমরা মাছ ধরি অগভীর জলে। আমরা কখনোই সামুদ্রিক সম্পদ পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারিনি। বিদেশি ট্রলারগুলো আমাদের জলসীমায় মাছ ধরে, অথচ আমরা পর্যাপ্তভাবে প্রস্তুত নই। এর জবাবে ড. কু পরামর্শ দেন, বাংলাদেশ যেন চীনের বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানিয়ে গভীর সমুদ্রের মাছের মজুদ নিরূপণ ও টেকসই আহরণ কৌশল প্রণয়নে সহায়তা নেয়।
বাংলাদেশের ফল রপ্তানির বিশাল সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, চীন ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের আম, কাঁঠাল ও পেয়ারা আমদানিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। তিনি ছোট কৃষকদের ফসল সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমাতে মোবাইল কোল্ড স্টোরেজ নকশার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেন। ড. কু বলেন, উচ্চমূল্যের নগদ ফল উৎপাদন কৃষি খাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জানান, ১৯৮০-এর দশকে জাপানে ফল রপ্তানির মাধ্যমে চীন কৃষি উন্নয়নে বিশাল সাফল্য অর্জন করেছিল। আগামী দিনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি উল্লেখ করেন, ২০২৬ সালে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ২০ বছর পূর্ণ হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা তা উদযাপন করব,’-বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসা করে এ কথা বলেন তিনি।