পিলখানায় ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর হত্যাকাণ্ডের দিন দরবার শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি ছাই রঙের গাড়ি দরবার হলের কাছে আসে। কিছু লোক কথাবার্তা বলে গাড়িতে উঠে পড়ে এবং গাড়িটা সদর রাইফেল ব্যাটালিয়নের রাস্তা দিয়ে সেক্টরের দিকে যেতে না যেতেই গোলাগুলীর আওয়াজ হতে থাকে। গাড়িতে যারা ছিল সবাই ইউনিফর্ম পরা। কিন্তু কোনো র্যাংক নাই। তাদের মাথার চুল বড়। তাদের হাতে এসএমজি ছিল। জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সাড়ে তিন হাজারের পৃষ্ঠার বেশি এই প্রতিবেদনে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্যও উঠে এসেছে। গত ৩০ নভেম্বর বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত কমিশন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সকাল ৯টা বেজে ১০/১২ মিনিটে দরবার হলের দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে বেল্ট ও টুপি ছাড়া ইউনিফরর্ম পরা দুজন বিজিবি সৈনিক অস্ত্র হাতে দৌড়ে স্টেজের উপরে উঠে আসে। প্রথমজন ডিজিকে অতিক্রম করে চলে যায় এবং দ্বিতীয়জন তার রাইফেলটি মেজর জেনারেল শাকিলের কপালের বাম দিকে তাক করে। ততক্ষণে বেশ কয়েকজন অফিসার ও সুবেদার মেজর স্টেজে উঠে আসে এবং সৈনিকটিকে নিরস্ত্র করে। কর্নেল আনিস এ্যামুনিশন আনলোড করে রাইফেলটিকে সুরক্ষিত করেন। সৈনিকটি মঞ্চের উপর পড়ে যায়।
কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নূরুল ইসলামসহ মঞ্চে থাকা অফিসাররা সৈনিকটিকে ১৩ রাইফেল ব্যাটালিয়নের সিপাহী মইনুদ্দিন হিসেবে সনাক্ত করে এবং তাকে বুটের ফিতা দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। অপর সৈনিক সিপাহী কাজল, সে দক্ষিণ দিকের জানালা দিয়ে বের হয়ে গিয়ে সম্ভবত একটা গুলী করে। গুলীর আওয়াজে দরবার হলের ভিতরে ‘জাগো’ বলে একটি চিৎকারের সাথে সাথে সকলে এদিক ওদিক ছোটাছুটি শুরু করে এবং দুই মিনিটের মধ্যে দরবার হল খালি হয়ে যায়। সৈনিক ও জেসিওদের সঙ্গে অনেক অফিসারও দরবার হল থেকে বের হয়ে যায়।
দরবার হলে যারা থেকে যান তাদের মধ্যে ছিলেন ডিজি, ডিডিজি (ব্রি. জেনারেল বারী), কর্নেল আনিস (ডিওটি), কর্নেল মসিউর, কর্নেল এমদাদ, কর্নেল জাহিদ, কর্নেল গুলজার, লে. কর্নেল কামরুজ্জামান, মেজর খালিদ, ক্যাপ্টেন মাজহার (এডিসি), ক্যাপ্টেন তানভীর, মেজর সালেহ, লে. কর্নেল এনশাদ, লে. কর্নেল আযম, ডিএডি ফসিউদ্দিন, এনএসএ এবং আরপি জেসিও, দুজন ইমাম, লে. কর্নেল ইয়াসমীন (ডাক্তার), মেজর রোকসানা (ডাক্তার), মেজর ফারজানা, লে. কর্নেল বদরুল, লে. কর্নেল কাউসার, কর্নেল লুৎফর প্রমুখ (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-১২০, সাক্ষী নম্বর-৪২, সাক্ষী নম্বর-৫৫ এবং সাক্ষী নম্বর-৮৪)।
হাবিলদার ইউসুফ দরবার হলের পেছনের দিকে বসেছিলেন। দরবার শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখেন একজন সৈনিক একটি এসএমজিসহ স্টেজে উঠে পড়ল। আরেকজন সৈনিক এসএমজিসহ দরবারের ভিতরে ঢুকে পড়ল। এরপর হঠাৎ করেই দরবারে প্রচণ্ড হুড়াহুড়ি শুরু হয়ে যায়। হাবিলদার ইউসুফ দরবার হল থেকে বের হয়ে একটি ছাই রঙের গাড়ি দরবার হলের কাছে আসতে দেখেন। তিনি লক্ষ্য করেন গাড়িতে যারা বসে আছে সবাই ইউনিফর্ম পরা। কিন্তু কোনো র্যাংক নাই। তিনি আরো লক্ষ্য করেন তাদের মাথার চুল বড়। তাদের হাতে এসএমজি ছিল। তারা কথাবার্তা বলে গাড়িতে উঠে পড়ে এবং গাড়িটা সদর রাইফেল ব্যাটালিয়নের রাস্তা দিয়ে সেক্টরের দিকে যেতে না যেতেই গোলাগুলির আওয়াজ হতে থাকে (সূত্র: কয়েদি সাক্ষী নম্বর-০৭)।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর দরবার হলে অফিসার, জেসিও এবং অন্যান্য পদবির বিডিআর সদস্যদের বসার আয়োজন ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের উপর ন্যস্ত ছিল। নন-কমিশন্ড অফিসাররা (এনসিও) সিপাহীদের পেছনে বেঞ্চে বসেছিলেন। জুনিয়র কমিশনড অফিসাররা (জেসিও) দক্ষিণ দিকে দুটি সারিতে বসেছিলেন এবং অফিসাররা দরবার হলের উত্তর দিকে তিন সারিতে বসেছিলেন। সিনিয়র অফিসার এবং সেক্টর কমান্ডাররা প্রথম সারিতে বসেছিলেন, বাকি অফিসাররা দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সারিতে বসেছিলেন। তৃতীয় সারি পদক এবং পুরস্কারপ্রাপ্ত অফিসার, জেসিও এবং সৈন্যদের জন্য নির্ধারিত ছিল। দরবার হলে স্টেজের উপরে ডিজি ও ডিডিজির বসার আয়োজন ছিল। ইউনিটগুলোর হিসাব অনুসারে দরবার হলে মোট দুই হাজার ৬৫০ জন উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে ১৩৩ জন কর্মকর্তা এবং ৭২ জন জেসিও ছিলেন (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-১২০ এবং সাক্ষী নম্বর-৫৫)।
সকাল ৯টায় ডিজি দরবার হলে পৌঁছান এবং সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মুজিব ডিজির কাছে প্যারেড হস্তান্তর করেন। ডিজি এবং ডিডিজি স্টেজের উপরে নিজ নিজ আসনে আসন গ্রহণ করেন। ডিডিজি ডিজির ডানে এবং সামান্য পেছনে অবস্থান গ্রহণ করেন। পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে দরবার শুরু হয়। জেনারেল শাকিল সর্বপ্রথম সবাইকে সম্ভাষণ জানিয়ে দরবার শুরু করেন। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর তিনি ডাল ভাত কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। জেনারেল শাকিল বলেন, সম্ভবত তোমাদের কারও কারও ডাল-ভাত এর হিসাবের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব আছে, আমি এখন কিছুটা হিসাব তোমাদেরকে বলছি, আমরা সর্বমোট ডাল-ভাত এ ৪০০ কোটি টাকার লেনদেন করেছি। ইতোমধ্যে যারা তোমরা এর সাথে জড়িত থেকে কাজ করেছো তাদের সকলকে সকল দিনের সম্পূর্ণ ডিএ দেওয়া হয়েছে এবং যারা ডাল-ভাতের সঙ্গে জড়িত ছিলে না তাদেরকেও ১০ দিনের করে ডিএ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সরকারের কাছ থেকে যে টাকা লোন নেওয়া হয়েছিল তার বেশিরভাগ ইতোমধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে।
ডিজি বলেন, এখনও অনেক মালামাল আছে যা বিক্রয় করে বাকি টাকা পরিশোধ করা হবে। পরবর্তীতে অডিট কমিটির মাধ্যমে সম্পূর্ণ হিসাব বের করা হবে। তোমরা এই ভেবে নিশ্চিত থেকো যে লাভের সব টাকা তোমাদের কল্যাণে ব্যবহৃত হবে। এ ব্যাপারে তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। একপর্যায়ে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনারা কি এই বিষয়ে সবকিছু বুঝতে পেরেছেন?’ বেশিরভাগ সৈনিক চুপ ছিল (সূত্র: সাক্ষী নম্বর- ১২০ ও সাক্ষী নম্বর-৫৫ এবং ডিজির ভাষণ সংযোজনী-১৫)।