মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন ‘ইতিহাস’ রচনা করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। পূর্র্ব ঘোষিত জাতীয় এ সমাবেশে যে সংখ্যক সাধারণ মানুষ ও নেতাকর্মীর ঢল নেমেছে, তা স্বাধীনতা পরবর্তীতে রেকর্ড হয়ে থাকবে। বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রথমবারের মতো একক জাতীয় সমাবেশ করে বিশ^বাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে দলটি। দেশের প্রায় সব বড় রাজনৈতিক দলই সময় সময় সমাবেশ করেছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। তবে এককভাবে জামায়াতে ইসলামী কখনো সমাবেশ করেনি। গতকালকের সমাবেশের মাধ্যমে রাজনীতির ময়দানে নতুন ইতিহাস গড়ল জামায়াতে ইসলামী।
সাত দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এ সমাবেশের ডাক দিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী। সেটিকে ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতিও ছিল সংগঠনটির। নেতাকর্মীদের দাবি ছিল, স্মরণকালের অন্যতম বৃহৎ জনসমাগম ঘটবে এ আয়োজনে। দিন শেষে সেটিই সত্যে পরিণত হলো। লাখো জনতার ঢেউ আচড়ে পড়েছে আশপাশের এলাকাসহ পুরো রাজধানীজুড়ে। গাবতলী থেকে চিটাগাং রোড়. উত্তরা থেকে সদরঘাট, সর্বত্রই লোকে লোকেরণ্য ছিল দেখার মতো। কারো হাতে ছিল দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা। অনেকের গায়ে ছিল সাদা গেঞ্জি, যেখানে লেখা- ‘তারুণ্যের প্রথম ভোট, জামায়াতের পক্ষে হোক’ এবং ‘দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিন’।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলা জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশে মানুষের ঢল দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ। নিজের ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে আব্দুল হান্নান মাসউদ লেখেন, গুদারাঘাট থেকে সকাল এগারোটায় বেরিয়েছি টিএসসিতে তরুণ লেখক ফোরামের প্রোগ্রামে জয়েন করতে। রাস্তায় কোন গাড়ি নেই, সেই হাতিরঝিল থেকে মানুষজন হাঁটছে। হাজার হাজার মানুষ, তাদের গন্তব্য একটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশস্থল, যেটার দূরত্ব প্রায় আট কি.মি.। গাড়ি আর সামনে এগুচ্ছে না। তিনি লিখেছেন, ১৬ বছর ধরে যাদের ন্যূনতম রাজনৈতিক স্পেস দেয়া হয়নি, তাদের এমন সমাবেশ সত্যিই অবিশ্বাস্য। হান্নান মাসউদ লেখেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই সমাবেশটি হয়তো একটি মীথ হয়ে থাকবে। অনেক গবেষণাও হবে হয়তো। একাত্তর প্রশ্ন এড়িয়ে ভোটের রাজনীতিতে তারা কতটুকু সফল হয়, এখন সেটাই দেখার পালা।
জানা গেছে, ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ ভারতে জন্ম লাভ করে ‘জামায়াত ইসলামী’ নামের সংগঠন। প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী। উপমহাদেশের আর কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতাকে ঘিরে এত আলাপ জারি নেই,যেটা মরহুম মাওলানা মওদুদীকে ঘিরে আছে। কারণ? তিনি অজস্র নতুন চিন্তা করেছেন। সেই চিন্তার লেখ্যরূপ দিয়েছেন। এক মাওলানা মওদুদীর সমস্ত কিতাব হতে পারে একজন গবেষকের সারা জীবনের বিস্ময়ের প্রধান উপাদান। উপমহাদেশের ইসলাম ও ইসলামি রাজনীতি নিয়ে ইসলামের সুমহান দর্শন নিয়ে এমন অজেয় দ্বিতীয় লেখক জন্মাননি। তার সব বক্তব্য মন্তব্য শিরোধার্য নয়, কিন্তু প্রতিপক্ষকে সামলে নেওয়ার জন্য অনিঃশেষ বাক্য-বাণী-যুক্তি-প্রতিযুক্তি তিনি রেখে গেছেন উত্তরসূরিদের জন্য। প্রতিষ্ঠার চুরাশি বছর পরে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে জনতার দাবি নিয়ে হাজির জামায়াতে ইসলামী। যেখানে সারাদেশ থেকে লাখ লাখ মানুষের ঢল নামে।
নির্মলেন্দু গুণ তার কবিতায় লিখেছেন, “কবির বিরুদ্ধে কবি- মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ, বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল- মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ...।” সেই সে মাঠে এই প্রথম গতকাল শনিবার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুখী সমৃদ্ধি ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করলেন জামায়াত নেতারা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াত যত কারণে আলোচিত তার মধ্যে সেরা তাদের দলীয় শৃঙ্খলা। গতকাল শনিবারও ঐতিহাসিক সোহরাওয়াদী উদ্যানে তার প্রদর্শনী হলো। নিজেকে দেখানোর প্রবণতার পরিবর্তে দৃশ্যমান অনুকরণীয় সহমর্মিতার। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রচিত হয়েছে সুখী সমৃদ্ধ সুখময় বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি সুপরিসর নগর উদ্যান। এটি পূর্বে রমনা রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিত ছিল। এক সময় ঢাকায় অবস্থিত ব্রিটিশ সৈন্যদের সামরিক ক্লাব এখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল। পরবর্তীতে এটি রমনা রেস কোর্স এবং তারপর রমনা জিমখানা হিসাবে ডাকা হত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর মাঠটিকে কখনও কখনও ঢাকা রেস কোর্স নামে ডাকা হত এবং প্রতি রবিবার বৈধ ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর রমনা রেসকোর্স নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। দেশের স্বাধীনতার স্মৃতিচিহ্নসহ নানা কারণে এটি রাজনৈতিকভাবে ঐতিহাসিক স্থান হিসেবেই পরিচিত।
রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘জাতীয় সমাবেশ’ ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য অনেক প্রশ্ন ও কৌতূহলের জন্ম দিবে! কারণ বছরের পর বছর যাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছিল, যাদের শীর্ষ নেতাদের কথিত বিচারের নামে হত্যা করা হয়েছিল, হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা-গুম করা হয়েছে, এমন একটি সংগঠনের আহবানে লাখো লাখো মানুষের উপস্থিতি একটি দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির পরিবর্তনের জন্যই যথেষ্ট। কেউকেউ বলেছেন, তোমরা যাদের শূন্য করে দিতে চেয়েছিলে, চেয়ে দেখো তারা আজ পরিপূর্ণ। সত্য-সুন্দরের পথকে কেউই রুখে দিতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না।
সোহরাওয়াদী উদ্যান আরও একটি বিরল ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকেবে। অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ আমীরে জামায়াত ডাক্তার শফিকুর রহমান বক্তব্য দিতে দিতেই অসুস্থ হয়ে স্টেজে পড়ে যান, তারপর তাৎক্ষণিক ট্রিটমেন্টের পর আবার দাঁড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু শরীর মানছিল না, এরপর স্টেজেই বসে পড়লেন। একদিকে সেবাশুশ্রূষা চলছিল, ডাক্তার প্রেশার দেখছিলেন, অন্যদিকে তিনি আবার তার বক্তব্য কন্টিনিউ করছিলেন! এবং বলছিলেন, আল্লাহ আমাকে যতটুকু হায়াত দিয়েছেন, তার এক সেকেন্ড আগেও আমার মৃত্যু হবে না, সেই পর্যন্ত আমি মানুষের জন্য কথা বলেই যাবো। এই মানুষটাকে এদেশের জন্য প্রয়োজন। যিনি বারবার অসুস্থ হয়ে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে তার বক্তব্য দিয়ে গেছেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যান্য সাক্ষী সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ঐতিহাসিক এ উদ্যানে সমাবেশ করেছে দেশের প্রায় সবগুলো বৃহৎ রাজনৈতিক দল। কিন্তু, জামায়াতে ইসলামী এককভাবে এ উদ্যানে সমাবেশ করেনি কখনো। অবশেষে ইতিহাস গড়ে প্রথমবারের মতো এককভাবে সোহরাওয়ার্দীতে সমাবেশ করেছে তারা। জামায়াতের উদ্দেশ্য ছিল, বড় ধরণের সমাবেশ করে রাজনীতির মাঠে নতুনভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করা। সেটিতে তারা সফল হয়েছেন। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা নিজেদের জানান দিয়েছে। শনিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘জাতীয় সমাবেশ’ করার মাধ্যমে নিজেদের সাংগঠনিক সক্ষমতা বিশ^কে জানান দিয়েছে দেশের জনপ্রিয় এই দলটি।
রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্মরণকালে বৃহত্তম সমাবেশ শুরুর অনেক আগেই দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উপস্থিতিতে কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে নেতাকর্মীদের ভিড় রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকা ছাপিয়ে যায়। দুপুরের পর পুরো রাজধানী যেন এক খন্ড সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রূপ নেয়। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে রাজধানীবাসীও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাবেশে যোগ দেয়।
দীর্ঘদিন পর রাজধানীতে এমন রাজনৈতিক সমাবেশের আয়োজনকে ঘিরে নেতাকর্মী, স্বেচ্ছাসেবক এবং প্রশাসনিক সমন্বয়কারীদের মধ্যে চোখে পড়ার মতো তৎপরতা দেখা গেছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে যখন তীব্র মতবিরোধ ও বিতর্ক চলছে, সে সময়ে সোহরাওয়ার্দীর এই সমাবেশ অনেক কিছুরই মোড় ঘুরিয়ে দিবে এটা নিশ্চিত।