* সংবিধান থেকে বহুত্ববাদ পুরো বাদ দেওয়ার প্রস্তাব জামায়াতের
* ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে জামায়াতের অবদান সবার স্মরণে থাকবে: আলী রীয়াজ
সংবিধান থেকে বহুত্ববাদকে পুরোপুরি বাদ দেওয়ার জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এর পরিবর্তে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপনের বিষয়টি সংযোজনের প্রস্তাব করেছে দলটি।
গতকাল শনিবার জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় সভা শেষে এ কথা জানান বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর, সাবেক সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের। এ অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় বৈঠকের জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।
মতবিনিময় সভায় জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে প্রতিনিধি দলে আরো ছিলেন, সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, ড. এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ, এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর নূরুল ইসলাম বুলবুল, সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট শিশির মোহাম্মদ মনির। প্যানেল সদস্য হিসেবে ছিলেন মহিউদ্দিন সরকার।
আলোচনা শেষ হয়নি জানিয়ে সাংবাদিকদের ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, ১০ জনের একটি সমন্বয় কমিটি এসেছি। সোয়া ৫টা পর্যন্ত আলোচনা করেছি। আজ মূলত সংবিধানের ওপর আলোচনা হয়েছে। সংবিধান সংশোধন কীভাবে হবে এ বিষয়ে পরে আলোচনা হবে। বহুত্ববাদকে পুরো বাদ দিতে বলেছি। প্রস্তাব করেছি সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করার জন্য। এছাড়া, একই ব্যক্তি দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয়; এই বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে একমত হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
বিষয়টি উল্লেখ করে ডা. আব্দুল্লাহ মো. তাহের আরও বলেন, বেশি তাড়াহুড়ো করছি না। উল্লেখযোগ্য সংস্কারের লক্ষ্য অর্জন করতে চাচ্ছি। কমিশনেরও লক্ষ্য জাতির জন্য প্রয়োজনীয় এবং অতিগুরুত্বপূর্ণ সংস্কারে পৌঁছানো। আজ কিছু বিষয়ে একমত হয়েছি, কিছু বিষয়ে নিজেরা প্রস্তাব দিয়েছি, কিছু বিষয়ে আরও আলোচনা প্রয়োজন। পরবর্তীতে আবার আলোচনা হবে। একমত হয়েছি একই ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।
তিনি বলেন, আর্টিকেল ৭০ এর ক্ষেত্রে কিছু সংশোধন সহকারে কমিশনের প্রস্তাবের সাথে একমত হয়েছি। সংবিধান পরিবর্তন, অর্থবিল বা বাজেট অনুমোদনের ক্ষেত্রে এবং আস্থা ভোট এই তিনটি বিষয় ছাড়া যেকোনো বিষয়ে একজন সংসদ সদস্য দলের মত ও অবস্থানের বিপরীতে ভূমিকা রাখতে পারবেন।
তিনি আরো বলেন, ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিলের ব্যাপারে নীতিগতভাবে একমত হয়েছি। আরও বিস্তারিত আলোচনা দরকার। এটি গঠনের প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান বিচারপতিকে কমিটিতে না রাখতে বলেছি।
এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আনুপাতিক হার (পিআর) সিস্টেমে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে উল্লেখ করে ডা. আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, এটা হলে নির্বাচনে যে দুর্নীতি, জবরদখল, ভোটবিহীন নির্বাচন ও টাকার খেলা বন্ধ হবে। বিশ্বের ৬০টির মতো দেশে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হচ্ছে। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের কথা বলেছি। নারী আসন বিষয়ে চূড়ান্ত আলোচনা এখনও হয়নি, কিছু আলোচনা হয়েছে।
এ আগে আলোচনার শুরুতে বিশ্বাসযোগ্য ও টেকসই গণতন্ত্রের জন্য জামায়াতে ইসলামী অঙ্গীকারাবদ্ধ বলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে জানিয়েছেন দলের নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামী কোনো রাষ্ট্রের রক্তচক্ষুকে ভয় পায় না, পরোয়া করে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কতিপয় ব্যাপারে খুবই দৃঢ় ও অঙ্গীকারবদ্ধ। প্রথমত হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। এজন্য আমরা কোনো রাষ্ট্রের রক্তচক্ষুকে ভয় করি না। স্বাধীনতার প্রশ্নে আমরা কারও হস্তক্ষেপ পরোয়া করি না। দ্বিতীয় তো একটি ক্রেডিবল (ক্রেডিবল গণতন্ত্র বলতে এমন একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বোঝায়, যা বিশ্বাসযোগ্য বা যার ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারে এবং যা স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও জনগণের মতামতের যথার্থ প্রতিফলন ঘটায়।) ও সাসটেইনেবল গণতন্ত্রের জন্য জামায়াতে ইসলামী অঙ্গীকারাবদ্ধ।
তিনি আরও বলেন, আমরা শুধু রাষ্ট্রের ভেতরে নয়, দলের ভেতরেও এই গণতান্ত্রিক চর্চা করি। আমাদের দলীয় নির্বাচন সময় মতো হয়। আমরা বলি এটাই আমাদের বৈশিষ্ট্য যে, নো ক্যাম্পেইন, নো ক্যান্ডিডেট, নো প্যানেল। এ ধরনের গণতান্ত্রিক নির্বাচনের চর্চা আমরা দেশে ফিরিয়ে আনতে পারি। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে স্বচ্ছ গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় জামায়াত। আমরা এমন নির্বাচন চাই, যেটিকে দেশের মানুষ, সারাবিশ্ব নির্বাচন বলবে।
ডা. তাহের আরও বলেন, যেখানে যেখানে নতুন কিছু সংযোজন বা বিয়োজনের প্রয়োজন আছে, যা দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর, সেখানে আমরা ব্যক্তি, দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি বা স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে চাই না, দেবও না। এর ঊর্ধ্বে থেকে দেশ জাতি ও মানুষের কল্যাণের জন্য যেটা প্রয়োজন জামায়াতে ইসলামী সেই কাজে সংস্কারে, পরিবর্তনে পরিপূর্ণ একমত পোষণ করে।
তিনি বলেন, একটি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ চায় জামায়াত। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের বর্তমান দুরাবস্থার পেছনে বড় দায় এই দুর্নীতি। একজন মানুষ যদি দুর্নীতিবাজ না হয়, দুর্নীতি না করে তাহলে তো কোনো নৈরাজ্য হওয়ার সুযোগ নেই। ভোট ছাড়া নির্বাচন করা বড় করাপশন, পরিশ্রম ছাড়া টাকা আয় বড় করাপশন, দুর্নীতির নামে উন্নয়ন বরাদ্দের টাকা ভোগ করা বড় করাপশন। আমরা খুব করে চাই, সিরিয়াস ডিমান্ড-আমরা চাই দুর্নীতিমুক্ত, জবাবদিহির বাংলাদেশ।
জামায়াত উন্নত শিক্ষা চায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা উন্নত শিক্ষা চাই যেখানে থাকবে নৈতিকতার শিক্ষা। দেশের জন্য, জাতির স্বার্থে মোরালবেইজড জবাবদিহিতা চাই। জবাবদিহিতা, নৈতিকতার সমস্যা বড় সমস্যা। আমরা নৈতিকতাসম্পন্ন উন্নত শিক্ষার আলোকিত সমাজ-রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়তে চায়। সে আলোকে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ ও কাজ করছি।
জামায়াতে ইসলামী কনস্ট্রাকটিভ, পজিটিভ ও প্রাকটিক্যাল রিয়েলিস্টিক সংস্কারের জন্য ঐকমত্য কমিশনকে পূর্ণ সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে বলে জানান তিনি।
এ দিকে সূচনা বক্তব্যে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামে জামায়াতে ইসলামীর অবদান নিঃসন্দেহে সবার স্মরণে থাকবে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় সংসদের এলডি হলে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে সূচনা বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। এ সময় তিনি আরও বলেছেন, বিচারিক এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার বাইরে বিচারবহির্ভূতভাবে আপনাদের (জামায়াতে ইসলামী) নেতাকর্মীরা নিপীড়ন, অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। তারপরও আপনারা সাহসিকতার সঙ্গে তা মোকাবিলা করেছেন, সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। সেজন্য আপনাদের প্রতি আমাদের সবার সমর্থন থাকছে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, গত ১৬ বছর ধরে যখন ফ্যাসিবাদী শাসনের নিপীড়ন বাংলাদেশকে জর্জরিত করে ফেলেছিল, সেই সময় জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছেন, গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। বিচারিক এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার বাইরে বিচারবহির্ভূতভাবে আপনাদের (জামায়াতে ইসলামী) নেতাকর্মী নিপীড়ন, অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। তারপরও আপনারা সাহসিকতার সঙ্গে তা মোকাবিলা করেছেন, সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। সেজন্য আপনাদের অভিনন্দন। আপনাদের প্রতি আমাদের সবার সমর্থন থাকছে।
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামে জামায়াতের অবদান নিঃসন্দেহে সবার স্মরণে থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশ এবং জাতি নতুন করে আবার পুনর্গঠিত হবে, যখনই আমরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করতে পারবো সেখানেও আপনাদের ভূমিকা থাকবে এটা আমরা আশা করি। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সময় আপনাদের (জামায়াতে ইসলামী) কর্মীরা সাহসিকতার সঙ্গে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। নেতারা কারাগারে আটক থেকেছেন, লড়াই সংগ্রামে উপস্থিত হয়েছেন।
আলী রীয়াজ বলেন, আমরা এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে আছি। আমাদের এই সুযোগ যারা তৈরি করে দিয়েছেন, বীর শহীদরা, তাদের কাছে আমাদের ঋণ আছে। যাতে কোনো অবস্থাতেই এই সুযোগ হাতছাড়া না হয়ে যায়। যেনো এ সুযোগকে কেন্দ্র করে আমরা এমন এক বাংলাদেশ তৈরি করতে পারি, যেখানে কোনো অবস্থাতেই কাউকে নিপীড়নের মুখে না পড়তে হয়, বিচার বা বিচারবহির্ভূত ব্যবস্থার মধ্যে যেনো তাকে মোকাবিলা করতে না হয়। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আমাদের যাত্রা।
তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেই উদ্যোগ সরকারের উদ্যোগ নয়, এটি বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের আকাক্সক্ষার ফল। তারই অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজন এবং তাগিদ রাজনৈতিক দল, জনসমাজ, ছাত্র, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এসেছে। সেই প্রক্রিয়ায় আপনারা (জামায়াতে ইসলামী) আন্তরিকভাবে অংশগ্রহণ করায় আপনাদের ধন্যবাদ জানাই।
আমাদের সবার সাফল্য নির্ভর করছে সবার আন্তরিক প্রচেষ্টার মধ্যে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা সবাই একত্রে আছি। সকলে মিলে আমরা এই চেষ্টাটা করছি। এটা কোনো রাজনৈতিক দলের একক বিষয় নয়, এটা সবার বিষয়। জাতির আকাক্সক্ষাকে ধারণ করার জন্য আমাদের চেষ্টা। আমাদের লক্ষ্য এক। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করছি। আমাদের সবার সাফল্য নির্ভর করছে সবার আন্তরিক প্রচেষ্টার মধ্যে।