ছিলেন ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম মহানগরের শীর্ষ নেতা। নিয়োগ সার্কুলারে ৩ বছর ৪ মাস বয়স কম ও ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ দিয়ে নিয়েছেন চাকরি। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের আমলে বিরোধী মতের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে করেছেন নানা ষড়যন্ত্র। নানা অজুহাতে বদলি, ওএসডি করা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। তার বিরুদ্ধে ছিল অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ, জালিয়াতি, চাকরিতে নিয়োগে তথ্য গোপনসহ আরো অনেক অভিযোগ। রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা-অভিযোগও। দীর্ঘ ১৬ বছর তেল সেক্টরে অবৈধভাবে দাপট দেখানো সেই ছাত্রলীগ নেতা মোরশেদ হোসাইন আজাদই পুরস্কৃত হয়েছেন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনে (বিপিসি)। যাকে জুলাই অভূত্থানের পর বিপিসি চট্টগ্রাম দফতরের মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া যার বিরুদ্ধে এতো অভিযোগ, সেই মোরশেদ হোসাইনকে করা হচ্ছে বিভিন্ন তদন্ত কমিটির সদস্য। অদৃশ্য শক্তির কারণে তার বিরুদ্ধে থাকা মামলা, নানা অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ গতি পাচ্ছে না। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিপিসির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে মোরশেদ হোসাইন আজাদকে নিয়োগ দেয়ায় রীতিমতো বিষ্ময়ও প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, যার বিরুদ্ধে আওয়ামী সরকারের আমলেই দুদকে অভিযোগ করা হয়েছে, যিনি মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকরিতে জয়েন করেছেন, তাকে বিপিসির গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীনতো দূরের কথা, ওএসডি করে তদন্ত করা উচিত ছিল। তারা বলছেন, অনতিবিলম্বে তার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগগুলোর তদন্ত না করলে তেল সেক্টরে অসন্তোষ তীব্র হতে পারে। তেল সেক্টরের অনেকেই জানান, বিপণন কোম্পানিসমূহে পান থেকে চুন খষলেই তদন্ত কমিটি করে বিপিসি। আর এ তদন্ত কমিটিতে সুকৌশলে ঢুকে পড়েন মোরশেদ।

জানা গেছে, স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানির জুনিয়র বিক্রয় সহকারী কায়সার হামিদের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগ, সরকারবিরোধী নাশকতাসহ অন্যান্য আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ আনেন। তার অপরাধ ছিল তিনি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধ মতের সমর্থক। যার ফলে একই বছরের ৩০ এপ্রিল তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক আবুল কালাম আজাদ স্বাক্ষরিত এক আদেশে কায়সার হামিদের বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়।

জানা গেছে, ২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর সালে মোরশেদ হোসাইনের বিরুদ্ধে দুদক ঢাকা অফিসে লিখিত অভিযোগ করেন তৎকালীন দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেল এর তৎকালীন পরিচালক উত্তম কুমার মন্ডল। যার স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৬২১.২৬.০০৩.২১.৩১০৩৯। সেখানে বিষয় দেখানো হয়, মোরশেদ হোসাইন আজাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ। একই আবেদনে দুর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ে দায়ের করা মামলার সূত্রও উল্লেখ করা হয়। যেটির স্মারক নং-০০.০১.২৬০০.৬২১.২৬.০১৫.১৮.২০৩৯.৫৪৩, তাং-১১/০৮/২০২১। দুদকের চট্টগ্রামে কেন্দ্রে মামলা করেন যমুনা অয়েল কোম্পানীর তৎকালীন পরিচালন কর্মকর্তা একেএম জাহিদ সরওয়ার।

সূত্র জানায়, মোরশেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর ঢাকা ও চট্টগ্রাম কার্যালয়ে একাধিকবার অভিযোগ করলেও দলীয় প্রভাবে কিছু দিন যেতে না যেতে তদন্ত কার্যক্রম থমকে যায়। দুদকের দায়ের করা অভিযোগে গঠিত তদন্ত কমিটির দায়িত্ব দেওয়া হয় সচিব কে। তখন পরবর্তী ১৬ দিন পরে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা থাকলেও গত চার বছরেও সেটি আলোর মুখ দেখেনি। অনেকেই আশা করেছিলেন, ছাত্র জনতার অভূত্থানের পর বিপিসি তার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত করবে। তার বিরুদ্ধে তো কোনো ব্যবস্থা নেয়াই হয়নি, বরং তাকে বিপিসির মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। যাকে রীতিমত বিস্ময়কর বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও বিপিসির গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্বে এখনো বহাল থাকায় ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন বিপিসির কর্মকর্তা।

জানা গেছে, ছাত্রজীবনে মোহাম্মদ মোরশেদ হোসাইন আজাদ ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি প্রথমেই অনৈতিক কার্যক্রম দিয়ে শুরু করেন তার চাকরি জীবন। বয়স, চুরি ও ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ দিয়ে চাকরির শুরু, এরপর একের পরে অনিয়ম দুর্নীতি অনিয়ম ও আর্থিক কেলেঙ্কারীর মাধ্যমে দ্রুত বৃত্ত-বৈভবের মালিক বনে যান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) আজাদ। সরকারি দলের কর্মকর্তা হওয়ায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পাননি। তবে প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের কারনে বর্তমানে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী ও সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগের শেষ নেই।

জানা গেছে, আজ থেকে প্রায় ১৬ বছর আগে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন লিমিটেডের উপব্যবস্থাপক হিসেবে যোগদান করেন। এর আগে ২০০৯ সালের ১৩ই মার্চ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন লিমিটেডে (বিপিসি) উপব্যবস্থাপক বিপণন পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হবার পর সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য অভিজ্ঞতা ও বয়সের বিষয়টি নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ওই নিয়োগের সংশ্লিষ্ট কাজের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাসহ অনূর্ধ্ব ৩৩ বছর (৩১-০৩-২০০৯) বলা হলেও ওই সময়ে তার বয়স ছিল ৩৬ বছর ৪ মাস ২১ দিন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ওই পদের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছিল আট বছর। কিন্তু সেখানে তার কোন ধরনের অভিজ্ঞতা না থাকা সত্বেও “গ্লোয়ার ট্রেডিং” নামের ভুয়া একটি প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা সনদ জমা দিয়ে উপ্যবস্থাপক (বিপণন) পদে নিয়োগ পান। তার এই নিয়োগ নিয়ে বিপিসির অডিট প্রতিবেদনেও আপত্তি রয়েছে। অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখানো হয় “গ্লোয়ার ট্রেডিং” নামে একটি অখ্যাত ভূয়া প্রতিষ্ঠানের সনদ পরে অডিট এ বিষয়টি ভুয়া হিসেবে ধরা পড়ে, এবং এ নিয়ে অডিট আপত্তি উত্থাপন করে। কিন্তু এসব অভিযোগ নিজস্ব ক্ষমতাবলে থামিয়ে দেন আজাদ। বলা হয়, তৎকালীন সময়ে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় ও আজাদ চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের যুগ সাধারণ সম্পাদক থাকার কারণে এসব জালিয়াতি ছাপিয়ে কোম্পানিতে অনেক প্রভাব বিস্তার করেন বেশ অল্প সময়ে।

আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনে প্রকাশ্যে কাজ করেছেন। ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট তার সাক্ষরিত এক পত্রের মাধ্যমে তিনি জাতীয় শ্রমিক লীগের নেতা আলী আজগরকে সার্বিক সহযোগিতা করতে সবার প্রতি অনুরোধ জানান। যার স্মারক নং-২৮.২৬.০০০০.০০২.০৭.০০১.২১।

জানা গেছে, মোরশেদ হোসাইন আজাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে দুদকে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদক নিজে তদন্ত না করে উল্টো বিপিসির সচিবকে তদন্তের ভার তুলে দেন। কিন্তু পরবর্তীতে সেই তদন্ত প্রতিবেদন আর আলোর মুখ দেখেনি। অভিযোগে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের বিষয়টি নিশ্চিত হতে তার এবং তার ভাতিজা ও ছোট ভাইয়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন পাম্প ও তেলের ডিপো থেকে নমুনা সংগ্রহ করে এবং তেলে ভেজাল দেওয়ার অভিযোগসহ বিভিন্ন অজুহাতে ঘুষ আদায় করেন তিনি। দুদকের কাছে অভিযোগে আজাদ এর সম্পদের চিত্র তুলে ধরা হয়, এতে বলা হয়, চট্টগ্রাম নগরী উত্তর আগ্রাবাদের মোল্লাপাড়ায় অবস্থিত নিরিবিলি আবাসিক এলাকায় প্রায় ১৬ শতাংশ জায়গার ওপর ছয় তলা আবাসিক ভবন নির্মাণ করেন। নগরীর কালামিয়া বাজার বেশ কয়েক শতাংশ মূল্যবান জায়গা কেনেন, নগরীর লালখান বাজারে অবস্থিত আমি সেন্টারে তার রয়েছে কয়েকটি দোকান। এই ঘটনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, উত্তর আগ্রাবাদের নিরিবিলি আবাসিক এলাকায় মোরশেদ হোসেন আজাদের ভবনের খোঁজ পাওয়া গেছে। কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা ব্যয় ভবনটি নির্মাণ করেন আজাদ।

সূত্র মতে, এতকিছুর পরেও তিনি থেমে নেই তার অনৈতিক কর্মকা-ে। ২০২৪ সালের ৮ আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর জ্বালানি উপদেষ্টার কাছে মোরশেদ হোসাইন আজাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে আরো একটি অভিযোগ জমা পড়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মোরশেদ হোসাইন আজাদ আমার কাজ দেখে আমাকে মহাব্যবস্থাপক অর্থ পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। ছাত্রলীগের সাবেক নেতা প্রসঙ্গে বলেন, আগে কি ছিলাম সেটি বিষয় নয়। বিপিসির প্রতিটি তদন্ত কমিটিতে তিনি থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, এটি বিপিসিই ভালো বলতে পারবে। নিয়োগ জালিয়াতির বিষয়টি তিনি অস্বীকার করে বলেন, সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই আমাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পূর্বের পদগুলিতে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়গুলি এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, কাজ করতে গেলে অভিযোগ আসবেই। অভিযোগের তদন্ত হলে তার সমস্যা নেই বলে তিনি জানান।

মোরশেদ হোসাইনের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান বলেন, আমি তো আপনার কাছ থেকে শুনলাম। খবর নিয়ে দেখবো, ঘটনার সত্যতা কতটুকু।