মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন। ৫ আগস্ট ২০২৪ বিজয় মিছিলে অংশ নিতে বের হন। আর উত্তরা পশ্চিম থানার সামনে যেতেই পুলিশ গুলী করেন মুখের বাম পাশের চাপায়। গুলীতে তার চাপার হাড্ডি এবং দাঁত ভেঙে চুরমার হয়ে আরেক চাপা দিয়ে বেরিয়ে যায়। তার জিহ্বা চার টুকরো হয়ে যায়। সব শেষ রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে দীর্ঘ এবং বিরল অপারেশন করে ডান পায়ের হাড্ডি কেটে এনে চোয়ালে স্থাপন করেছেন। হাসপাতালে বসে সে গল্প বলেছেন দৈনিক সংগ্রামকে। লিখেছেন ইবরাহীম খলিল।

দৈনিক সংগ্রাম : আপনার মুখে গুলী করা হয়েছে। আপনার চাপার হাড্ডি ভেঙে দাঁতগুলো খুলে পড়ে গেছে। গুলীর বারুদের কারণে আপনার জিহ্বা পচন ধরে। বড় কথা হলো বাংলাদেশে আপনার একটা বিরল চিকিৎসা হয়েছে। আপনার চিকিৎসার সম্পর্কে যদি একটু বলেন।

মো: আব্দুল্লাহ আল মামুন : আমি আন্দোলনের শুরু থেকে মাঠে ছিলাম। আমি ৫ তারিখে বিজয় মিছিল করে উত্তরার দিকে যাচ্ছিলাম। আমি যখন উত্তরা থানার সামনে যাই তখনই আমার বাম পাশের চাপায় গুলী করে পুলিশ। তাতে নিচের যে চোয়াল দাঁত সব চুরমার হয়ে যায়। মুখের মধ্যের জ্হিবাটা চার খন্ড হয়ে যায়। এরপর উত্তরা উমেন যে হাসপাতাল আছে, সেখানে নিয়ে যায় একজন রিকশাওয়ালা। সেখান থেকে মূলত চিকিৎসা শুরু হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেখানে যখন সেফটি শক হয় তখন আমাকে ঢাকা মেডিকেলে রেফার করা হয়। ঢাকা মেডিকেলে আনার পর আমার জিহ্বায় পচন ধরে। এই পচন কেটে ফেলানোর জন্য সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখ অপারেশন করা হয়। জিহ্বা কেটে ফেলা হয়। এখন আমার মুখে জিহ্বা অর্ধেক আছে। সেখানে আমার আরও কিছু সমস্যা হয়। কিডনিতে সমস্যা হয় ফুসফুসে পানি জমে। কিডনিতে ডায়ালাইসিস করা লাগে ৪ বার। এরপর দেখা গেলে যে মুখে অপারেশন প্রয়োজন। কারণ মুখেতো হাড্ডি নাই।

দৈনিক সংগ্রাম : ঢামেক থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এলেন কবে ?

মো: আব্দুল্লাহ আল মামুন : গত রোজার ঈদের পর। এখানে এসে দেখা হয় ডা. মোস্তাফিজুর রহমান মামুনের সাথে। তিনি পা থেকে হাড় নিয়ে চোয়াল বানায় এবং তার উপর মাড়ি স্থাপন করা হয়। এই অপারেশনটা সোহরাওয়ার্দীতে হয়। যে অপারেশনটা হয়েছে তা বাংলাদেশে দুর্লভ। আমার মুখের যে ফেস কাটিংটা দেখতেছেন, হাতের হাড্ডি থেকে এরকম সেইফ হয় না। পা থেকে হাড্ডি কেটে নিয়ে ডাক্তার ইন্ডিয়াতে কথা বলেন। সেখান থেকে থ্রিডি সিস্টেমে মুখের মধ্যে মাড়ি মুখের সাইজ অনুযায়ী মুখে মাংস লাগবে। রগ লাগবে। সব কিছু ডিজাইন করে বিদেশে পাঠায়। এরপর এপ্রিলের ৮ তারিখ পরবর্তী অপারেশনটা হয় ১৪ ঘন্টা যাবত। পা থেকে হাড় এবং মাংস নেয়। অপারেশনের পর আমি জানতে পারি এই ধরণের অপারেশন বাংলাদেশে এটাই প্রথম।

দৈনিক সংগ্রাম : এই অপারেশনের নাম কি?

মো: আব্দুল্লাহ আল মামুন : ফ্রি ফেবুলাফিয়া।

দৈনিক সংগ্রাম : এখন আপনার শরীরের কি অবস্থা ?

মো: আব্দুল্লাহ আল মামুন : এখন অনেক ভাল আছি। আমার মুখের নিচের পাটিতে একটা দাঁতও নেই। ওপওে ৮টা দাঁত ভাঙা ছিল। উপরে ৮টা দাঁতের মধ্যে ৪টা দাঁত লাগানো হয়েছে। আরও ৩টা দাঁত লাগানোর কাজ চলছে। আমার নিচে ইমপ্লান্ট করে দাাঁত লাগানো হবে। এতে অনেক বেশি খরচ। প্রতি দাঁতে প্রায় এক লাখ টাকা লাগে। আমার দাতগুলো লাগাতে প্রায় ২০ লাখ টাকা প্রয়োজন। আমার দাঁত লাগানোর ব্যয়টা যেন সরকার বহন করে। সেই আবেদন আপনাদের মাধ্যমে করি।

দৈনিক সংগ্রাম : আপনি কি বিদেশ যেতে চান ?

মো: আব্দুল্লাহ আল মামুন : এখন যে ডাক্তারের আন্ডারে আছি তিনি অনেক ভাল। এখানেই ভাল চিকিৎসা সম্ভব। কেবল মেটারিয়ালের খরচটা দিলেই হবে। আপনি হয়তো বলবেন যে বিদেশ যেতে চান না কেন? আমি বলবো আরেকজনকে রাশিয়া পাঠানো হয়েছে। ওর চিকিৎসা আর আমার চিকিৎসা এক। আল্লাহর রহমতে আমার ডাক্তারের চিকিৎসা খুবই ভাল।

দৈনিক সংগ্রাম : তাহলে আপনি বলছেন যে বাংলাদেশেও বিদেশী চিকিৎসা সম্ভব ?

মো: আব্দুল্লাহ আল মামুন : জি¦।

পাশে থাকা মো: আব্দুল্লাহ আল মামুনের ছোটভাই ফেরদৌস চৌধুরী জানান, পায়ের হাড্ডিটাকে কেটে নিয়ে তিন টুকরা করে মুখের চোয়াল হিসেবে লাগানো হয়েছে। এসময় আইসিইউ সার্পোট লাগে দীর্ঘদিন। গুলী লাগার পর ঢাকা উইমেন হাসপাতালে ভর্তি হয়। সেখানে ৭ তারিখে অপারেশন হয়। তখন তার মুখে হাড় চিহ্বান দাত কিছুই ছিল না। জিহ্বাটা চার টুকরা হয়ে ছিল। ভাগ্যভালো যে পরে যায়নি। সেখানে জ্হিবা সেলাই এবং চামড়া-মাংস টেনে নিয়ে সেলাই দেওয়া হয়। সেখানে যখন সেইফটি শক হয় তখন ২৬ আগস্ট আমাদের ঢাকা মেডিকেলে রেফার করা হয়। আইসিইউ থেকে আইসিই্উতে রেফার করা হয়। ডাক্তার বলছিল বাঁচবে না। কিন্তু আল্লাহর রহমত থাকায় এখন আমার ভাই অনেকটাই সুস্থ হয়ে গেছেন। আমরা যখন ঢাকা মেডিকেলে যাই তখন ২ মাসের মতো আইসিইউতে ছিলাম। প্রায় প্রতিদিন রক্ত দেওয়া লাগতো। আমরা দেখলাম মুখের মধ্যে যে মাংসটা ছিল বারুদের কারণে সেই মাংসটা পঁচে যায়। তাতে সমস্ত শরীরে ইনফেকশন হয়ে যায়। সেখানে ডেন্টালের ডাক্তার মুখের পচা মাংসটুকু কেটে ফেলে। পরবর্তীতে কল্যানপুরে কিছুদিনের জন্য একটা বাসায় উঠি। সেখানে থেকেও চিকিৎসা করা হয়। ঢাকা মেডিকেল থেকে যখন ছেড়ে দেওয়া হয় তখনো তার শরীরে নিউমোনিয়া ছিল। ফুসফুসে পানি জমেছিল। এই অবস্থাতেও ঢাকা মেডিকেল আমাদের ছেড়ে দেয়। আসলে ভাইয়ের মূল অপারেশনটা সোহরাওয়ার্দীতে। আমরা খোজ নিচ্ছিলাম যে কোথায় চিকিৎসা নেওয়া যায়। পরে সোহরাওয়ার্দীতে এসে ডাক্তার মামুন স্যারের সাথে কথা বলি। ওনার সাথে কথা বলে অনেক ভাল লাগে। পরে ওনার আন্ডারে ভর্তি করাই ভাইকে।