তোমার দাদা আমার দাদা, রাজাকার-রাজাকার, তোমার বাবা, আমার বাবা, রাজাকার-রাজাকার, তুমি কে ? আমি কে ? রাজাকার-রাজাকার। এগার মাস পর মধ্যরাতে এমন স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই রাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। সেদিন বিকালে স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রীর ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বক্তব্যের প্রতিবাদে রাজপথে নেমে এসেছিল শিক্ষার্থীরা। সেদিন বিক্ষোভে ফেটে পড়া সেই শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে ছিল প্রতিবাদের সুর। হাসিনার সেই ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বক্তব্যের জবাবে শিক্ষার্থীরা পাল্টা স্লোগান ধরে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’। তবে এবার জুলাইয়ের ১৪ তারিখে উদযাপন করা হলো ভিন্ন আবহে।
দিনটিকে স্মরণ করে সোমবার রাতে ফের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতশত শিক্ষার্থী রাজপথে নেমে সেই স্লোগানে মিছিল করেন। আগের বছর আর এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন থাকলেও এবার শিক্ষার্থীরা তুমি কে ? আমি কে ? তোমার দাদা আমার দাদা, তোমার বাবা আমার বাবা। এক স্বরে স্লোগান দেয় রাজাকার রাজাকার। প্রতিক্রিয়ায় সেদিন রাতে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে মধ্যরাতে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হন। পরবর্তীতে ছাত্র-জনতার সেই বিক্ষোভ শেষ হয় ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মাধ্যমে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে এবারের এই প্রতীকী মিছিলে বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা এসে এই কর্মসূচিতে অংশ নেন। স্লোগানে ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার, কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’; ‘ফাঁসি ফাঁসি চাই, শেখ হাসিনার ফাঁসি চাই’; কোটা না মেধা, মেধা মেধা’ প্রভৃতি স্লোগান দেন তারা। প্রতীকী মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় প্রদক্ষিণ করে।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের এই দিনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে?
এই মন্তব্য আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। ওই রাতেই ঢাবির শিক্ষার্থীরা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় হল ছেড়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নেন। দেশজুড়ে শুরু হয় এক নতুন মাত্রার ছাত্র আন্দোলন। মাত্র তিন সপ্তাহ পর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
বর্ষপূর্তির দিনে আয়োজকদের একজন বলেন, তৎকালীন শাসক শেখ হাসিনা আমাদের রাজাকার বলে অপমান করেছিলেন। সেই কটূক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক বছর পূর্ণ হওয়ায় আমরা আজ এই প্রতীকী মিছিল করেছি।
এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজন করা হয় এ ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজনের। শতাধিক ড্রোন আবারও ফুটিয়ে তুললো চব্বিশের জুলাইয়ে নারীদের সাহসী, বিপ্লবী অবদান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিমোহিত দৃষ্টিতে তা দেখেন।
এছাড়া ঢাবির রাজু ভাস্কর্য চত্বর থেকে শুরু হয়ে পুরো টিএসসি চত্বর এবং শহীদ মিনার এলাকা শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে ‘জুলাই উইমেন্স ডে’ উপলক্ষ্যে অয়োজিত রাতের এ কর্মসূচি উপলক্ষ্যে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানায়, এই শো-এর উদ্দেশ্য ছিল ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে সাহসী নারীদের ভূমিকা স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানো। ওই বছর ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা হলের তালা ভেঙে প্রথম বিক্ষোভের ঝাণ্ডা তুলে ধরেন। যেখান থেকে শুরু হয়েছিল একটি নতুন ইতিহাস-গঠনের অধ্যায়।
এদিকে অভ্যুত্থানে নারী শিক্ষার্থীদের অসামান্য ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ প্রতি বছর ১৪ জুলাই ‘নারী শিক্ষার্থী দিবস’ পালন করা হবে। এ দিবসটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত একাডেমিক ক্যালেন্ডারে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এছাড়াও, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সাহসী প্রতিরোধের ঐতিহাসিক অবদানের স্মরণে প্রতি বছর ১৭ জুলাই ‘সন্ত্রাস প্রতিরোধ দিবস’ পালন করা হবে। এটিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ক্যালেন্ডারে যুক্ত থাকবে।
গতকাল সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে আয়োজিত কর্মসূচিতে তিনি এসব কথা বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান।
অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সকল শিক্ষার্থীকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বলেন, সেদিন যারা যোগ দিয়েছিলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও মাদরাসাসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে যারা এসেছিলেন তাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। ছাত্র জনতার এই অভ্যুত্থান আমাদের সামনে একটি নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। সে সুযোগ যাতে আমরা কাজে লাগাতে পারি, সেজন্য আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ থাকছি।
এসময় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পুনর্জাগরন অনুষ্ঠানমালা আয়োজন বিষয়ে সরকার কর্তৃক গঠিত কমিটির আহ্বায়ক কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. এম. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদ উপস্থিত ছিলেন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকীর এই অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা অংশ নেন। এদিন ছাত্রীরা আন্দোলনের দিনের মতো হল থেকে মিছিল নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে আসেন। তারা সেদিনের স্লোগান পুনরায় দেন এবং রাতভর দিবসটি উদযাপনে নানা কর্মসূচি পালন করেন। এর আগে, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জুলাই পুনর্জাগরণ অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন হিসেবে ‘ঔটখণ ডঙগঊঘদঝ উঅণ’ পালন করা হয়। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় ও মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. এম. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদ উপস্থিত ছিলেন। সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটি শুরু হয়। এরপর জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে চলচ্চিত্র প্রর্দর্শনী, প্রতিবাদী গান, স্মৃতিচারণ ও ড্রোন শো-এর আয়োজন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পয়েন্টে এলইডি বোর্ড স্থাপন করে অনুষ্ঠান দেখার ব্যবস্থা করা হয়।