জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে তিন দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাবি শাখা। নানা বাধা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তৃতীয় দিনের সমাপনী আয়োজনে ছিল দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড়। শিবিরের এই আয়োজনে দর্শনার্থীদের আগ্রহ, প্রচার এবং অংশগ্রহণ দেখে বোঝা যায়, নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তারা জুলাই অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরতে বদ্ধপরিকর। এই প্রদর্শনীতে ছাত্রশিবিরের কৌশলগত অবস্থানের কারণে তাদের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা আরও একদাপ বাড়লো বলে মত দিয়েছেন প্রদর্শনী দেখতে আসা শিক্ষার্থীরা। কর্মসূচি দেখতে টিএসসিতে ভিড় করছেন দর্শনার্থীরা। প্রদর্শনীতে জুলাই অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আয়োজনে সকাল ৯টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত জুলাইয়ের বিশেষ চিত্র প্রদর্শনী চলেছিল।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, টিএসসি চত্বরে শিবিরের আয়োজন ঘিরে শিক্ষার্থী, দর্শনার্থী ও অনুসারীদের সরব উপস্থিতি। তথ্যচিত্র প্রদর্শনী থেকে শুরু করে সেমিনার ও আলোচনা পর্বে ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। তবে এ কর্মসূচিকে ঘিরে প্রথম দিনেই তৈরি হয় উত্তেজনা। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জুলাই অভ্যুত্থানের প্রদর্শনীতে বিচারের নামে প্রহসণের মাধ্যমে হত্যাকান্ডের শিকার ১৯৭১ সালে কথিত যুদ্ধাপরাধে দ-িত ব্যক্তিদের ছবি প্রদর্শনের অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে এবং বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রবল আপত্তির মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেই ছবি সরিয়ে নেয়।

ঢাবির টিএসসিতে তথ্যচিত্র প্রদর্শনী দেখতে আসা দর্শনার্থীরা জানান, ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসে যে কাজগুলা করতেছে, যেকোনো দল করুক আমি এপ্রিশিয়েট করবো। ছাত্রদের কাজ সারাদিন মারামারি-কাটাকাটি, মধুর ক্যান্টিনে গিয়ে বড় ভাইদের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা নয়। ছাত্র সংগঠন এরকম সাংস্কৃতিক কাজ করবে, ক্রিয়েটিভ কাজ করবে- এগুলার মাধ্যমে স্টুডেন্টদের মেসেজ দিবে। তুলে ধরবে জুডিশিয়াল কিলিং কিভাবে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে, তুলে ধরবে ভারতীয় আধিপত্যবাদ কেন আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ। তুলে ধরবে আবু সাইদ, ওয়াসিম, আবরার ফাহাদদের গল্প। ছাত্র সংগঠনগুলার উচিত ট্রেডিশনাল রাজনীতির বাইরে গিয়ে এখন এরকম চিন্তা করা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) টিএসসি চত্বরে ছাত্রশিবিরের চিত্র প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া উত্তেজনার রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও প্রদর্শন করা হলো জামায়াত নেতা মরহুম আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছবি। তবে এবার ছবির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে রংপুরের শহীদ আবু সাঈদ ও ছাত্রদল নেতা শহীদ ওয়াসিমের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া মন্তব্য। গতকাল বৃহস্পতিবার ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে টাঙানো ছবিতে ২০২৩ সালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর আবু সাঈদ ও ওয়াসিমের দেওয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করা হয়। পরে দ্বিতীয় দিনে আগের স্থানে স্থান পায় ভিন্নধর্মী উপস্থাপনা, যেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বক্তব্যসহ ছবি, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ তথ্য, স্কাইপ কেলেঙ্কারি, মানবাধিকার আইনজীবী জিওফ্রে রবার্টসনের মন্তব্য, সুরঞ্জন বালির মন্তব্য এবং ভুয়া স্বাক্ষীদের জবানবন্দি সংবলিত পোস্টার টানিয়ে দেওয়া হয়।

জানা গেছে, ফ্যাসিবাদের পতনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাবির টিএসসি এলাকায় আলোকচিত্র প্রদর্শনী করা হচ্ছে। এর আঙিনা তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্রের আদলে। তবে বিষয়টি অনেকে নিচ থেকে বুঝতে পারেননি। ওপর থেকে ড্রোন চিত্র দেখে অনেকে মানচিত্রের বিষয়টি বুঝতে পেরে ফেসবুকে নানা ধরনের মন্তব্য করছেন। ড্রোন দিয়ে তোলা পুরো প্রদর্শনীর একটি ছবি শেয়ার করে হোসাইন আহমেদ জোবায়ের নামে একজন লিখেছেন, ‘এ যে আমাদের মানচিত্র! নীচে বারবার হেঁটেও খেয়াল করতে পারিনি। আবিদ হাসান মন্তব্য করেছেন, ড্রোন শট ছাড়া বোঝার কোন উপায় নাই। সাইমুমের টাও সেইম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী আনিছুর রহমান জুয়েল পোস্ট করেছেন, টিএসসিতে শিবিরের আয়োজনের ভেন্যুর এই মানচিত্র তো আগে খেয়ালই করিনি। ইন্টারেস্টিংলি বেশ ক্রিয়েটিভ লাগছে ব্যাপারটা।’ অনেকে অবশ্য এর সমালোচনাও করেছেন। এ ছাড়া টিএসসি অডিটোরিয়ামে দিনব্যাপী বিশেষ সেমিনার আয়োজিত হয়। সেমিনারের তিনটি অধিবেশনে বক্তারা আলোচনা করেন, জুলাই অভ্যুত্থান ও ফ্যাসিবাদ পলায়নের এক বছর: প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা। জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী ছাত্ররাজনীতি ও ডাকসু নির্বাচন। নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তে ইসলাম প্রসঙ্গ। এ ছাড়া প্রদর্শনীতে তুলে ধরা হয় শহীদদের স্মরণে নির্মিত ডকুমেন্টারি ও প্রামাণ্যচিত্র।

বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনার্থী আহমাদুল্লাহ নোমান বলেন, ছাত্রশিবিরের এই ব্যতিক্রমধর্মী কর্মসূচি আমাদের ফ্যাসিবাদের নির্মমতা ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কথা মনে করিয়ে দেয়। আবরার ফাহাদ ও বিশ্বজিৎ হত্যাকা-ের তথ্যচিত্র আমার আবেগকে নাড়া দিয়েছে। এসব আয়োজন ইতিহাস সচেতনতা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

উল্লেখ্য যে, আমরাই ৩৬ জুলাই: আমরা থামবো না শীর্ষক আয়োজনে প্রথমে প্রদর্শিত হয়েছিল মানবতাবিরোধী অপরাধে দ-িত জামায়াত নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মুজাহিদ, মীর কাশেম আলী, কামারুজ্জামান এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছবি। বামপন্থী বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন এতে আপত্তি জানায়। জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর আবু সাঈদ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুক। বিদায় হে রাহবার। একদিন পর, ১৫ আগস্ট শহীদ ওয়াসিম তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, একজনের মৃত্যুতে দেশব্যাপী অঘোষিত শোক চলছে, আরেকজনের আনুষ্ঠানিক শোকেও মানুষের শোক হয় না। ধর্মীয় ব্যক্তি ও ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তির মধ্যে এটাই উজ্জ্বল উদাহরণ। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী কোটি মানুষের মনি কোঠায়।