* ইউরোপে অভিবাসনের শীর্ষে বাংলাদেশীরা
দক্ষিণ এশিয়া এবং দরিদ্র দেশগুলোর মানুষের কাছে ইউরোপ স্বপ্নের নাম। আর এই স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে হয়। সেখানেই সলিল সমাধি হয় অনেকের। বাংলাদেশীরাও এর মধ্যে রয়েছে। উন্নত জীবনের স্বপ্নে বিভোর এসব তরুণ অজান্তেই মৃত্যুর পথে অগ্রসর হচ্ছে। উন্নত স্বপ্নের আশা দিয়ে তাদের ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়। মানব পাচার সাধারণত অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোতে একটি সমস্যা। উন্নত দেশে উন্নত স্বপ্নের পথে অনিশ্চিত যাত্রা করে তারা। সেখানে পৌঁছাতে গিয়ে তারা দালালের আশ্রয় নেয়। একসময় সেই দালাল চক্রের সদস্যদের হাতে নির্মমভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। মোটা অংকের টাকা দিয়ে কারও কারও মুক্তি মেলে। মাঝেমধ্যেই সেসব খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আবার কখনো যাত্রায় স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে তীব্র ঠান্ডায়, নৌকা ডুবে বা খাদ্যের অভাবে মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে। জেনেভা থেকে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালকে অভিবাসীদের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক বছর হিসেবে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘ। গতকাল শুক্রবার সংস্থাটি জানিয়েছে, ওই বছর বিশ্বব্যাপী অভিবাসন পথে প্রায় ৯ হাজার মানুষ মারা গেছেন। এছাড়াও অভিবাসন বিষয়ক জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এ রিপোর্ট মতে, গত ১০ বছরে কমপক্ষে ৬৪ হাজার অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে পানিতে ডুবে। এই হিসাবে পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ৩৬ হাজার। সেই হিসেবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৭৩ হাজার অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও এক দশকের হিসাবে ২০২৩ সালকে অভিবাসীদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ বছর হিসাবে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘ। ওই বছর সারা বিশ্বের অভিবাসন রুটে মারা গেছেন অন্তত আট হাজার ৫৬৫ জন অভিবাসী।
জাতিসংঘ এই মৃত্যুকে অগ্রহণযোগ্য ও প্রতিরোধযোগ্য ট্র্যাজেডি বলে অভিহিত করেছে। জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) জানিয়েছে, ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী অভিবাসন পথে অন্তত ৮ হাজার ৯৩৮ জন মারা গেছেন। গত পাঁচ বছর ধরে মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। আইওএম জানায়, অভিবাসন প্রত্যাশীদের মৃত্যু ও নিখোঁজের প্রকৃত সংখ্যা সম্ভবত অনেক বেশি। কারণ সরকারি সূত্রের অভাবের কারণে অনেক ঘটনাই অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। ২০২৪ সালে এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপে রেকর্ডসংখ্যক মানুষ মারা গেছেন। যা যথাক্রমে ২ হাজার ৭৭৮, ২ হাজার ২৪২ এবং ২৩৩ জন। ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টাকারীদের প্রধান প্রবেশদ্বার ভূমধ্যসাগরে মোট ২ হাজার ৪৫২ জন মারা গেছেন বলে রেকর্ড করা হয়েছে। খবরে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি, তবে সবশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী সেখানে কমপক্ষে এক হাজার ২৩৩ জন মারা গেছেন। তাছাড়া ২০২৪ সালে ক্যারিবিয়ানে ৩৪১ জন প্রাণ হারিয়েছেন, কলম্বিয়া এবং পানামার মধ্যবর্তী ড্যারিয়েন জঙ্গল অতিক্রম করতে গিয়ে ১৭৪ জন অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে।
জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইওএম এক বিবৃতিতে বলেছে, ২০২৩ সালে অভিবাসন রুটে অভিবাসীদের মৃত্যুর হার তার আগের বছরের তুলনায় অন্তত ২০ ভাগ বেড়েছে। অভিবাসন রুটে প্রাণহানি ঠেকাতে জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। সংস্থাটির উপ মহাপরিচালক উগোচি ড্যানিয়েলস বলেছেন, প্রতিটি মৃত্যু একেকটি ভয়ানক মানবিক ট্র্যাজেডি, যা আগামী দিনগুলোতেও পরিবার এবং সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করবে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, পানিতে ডুবে যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে বেশির ভাগই সমুদ্রে ডুবেছেন। এর মধ্যে আবার ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা গেছেন কমপক্ষে ২৭ হাজার অভিবাসী। উত্তর আফ্রিকা থেকে ইউরোপের দক্ষিণে পৌঁছানোর জন্য এই সাগরকে দেখা হয় গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে। আইওএম বলেছে, তারা যে সংখ্যা উপস্থাপন করেছে তা প্রকৃত সংখ্যার ভগ্নাংশ মাত্র। বার্লিনে আইওএমের ডাটা এনালিস্ট আঁন্দ্রে গারসিয়া বোরজা বলেন, ভূমধ্যসাগর হলো চরম ভয়াবহ এলাকা। এই পথে ভ্রমণ চরমমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ। ভূমধ্যসাগরে মৃত্যুর যে সংখ্যা পাওয়া গেছে তা হয়তো বাস্তব সংখ্যার কাছাকাছি। কিন্তু অন্য অঞ্চল, যেমন সাহারা মরুভূমির মতো অঞ্চলগুলো পর্যবেক্ষণ করা কঠিন। এসব স্থানের নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া আরও কঠিন।
আইওএম বলেছে, যেসব মানুষ এই পথে নিখোঁজ হয়েছেন তার প্রতি তিনজনের মধ্যে দু’জনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। অর্ধেক মৃত্যুর বিষয়ে মৃত ব্যক্তির লিঙ্গ বা বয়স নির্ধারণ করতে পারেনি আইওএম। তবুও যাদেরকে শনাক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে এক তৃতীয়াংশ যুদ্ধকবলিত দেশগুলোর অথবা বৃহৎ সংখ্যক শরণার্থী। কোনো রকম নিরাপত্তা ছাড়া এসব মানুষ যুদ্ধকবলিত এলাকা থেকে পালাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে তারা কী নির্মমতার মুখোমুখি।
২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে অভিবাসন রুটে মারা গেছেন কমপক্ষে ৮৫০০ মানুষ। এক দশক আগে আইওএম ডাটা সংগ্রহ শুরু করে। তখন থেকে এটাই ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী বছর। এখন পর্যন্ত এ বছর যে পরিমাণ মানুষ এভাবে মারা যাওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা কম উদ্বেগের নয়। ২০২৩ সালের তুলনায় ভূমধ্যসাগরে আগত অভিবাসীর সংখ্যা কমেছে। তবু সেখানে গত বছরের মতোই ঊর্ধ্বমুখী মৃতের সংখ্যা। আইওএম বলেছে, তল্লাশি এবং উদ্ধার সক্ষমতা আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এর মধ্য দিয়ে অভিবাসীদের মৃত্যু কমিয়ে আনা যাবে।
ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত যে সংখ্যক মানুষ অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন বাংলাদেশীরা। তাদের সংখ্যা তিন হাজার ৩৩২ জন। এরপরই রয়েছেন তিউনিশিয়ানরা। তাদের সংখ্যা দুই হাজার ৯৬২ জন। তিনি বলেন, ২০১৪ সালে অবৈধভাবে সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে যান দুই লাখ ২৫ হাজার ৪৫৫ মানুষ। তাদের মধ্যে মারা যান তিন হাজার ৫৩৮ জন। ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ পাড়ি দেন ১০ লাখ ৩২ হাজার ৪০৮ জন, মারা যান তিন ৭৭১ জন। ২০১৬ সালে তিন লাখ ৭৩ হাজার ৬৫২ জন, মারা যান পাঁচ হাজার ৯৬ জন। ২০১৭ সালে এক লাখ ৮৫ হাজার ১৩৯ জন পাড়ি দেন, পথে মারা যান তিন হাজার ১৩৯ জন। ২০১৮ সালে পাড়ি দেন এক লাখ ৪১ হাজার ৪৭২ জন, মারা যান দুই হাজার ২৭০ জন। ২০১৯ সালে এক লাখ ২৩ হাজার ৬৬৩ জন পাড়ি দেন, মারা যান এক হাজার ৩৩৫ জন। ২০২০ সালে ৯৬ হাজার ৩১ জন অবৈধ পথে সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছাতে পারলেও পথে মারা যান এক হাজার ৪০১ জন। গত এক দশকে এভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় আটক হয়েছেন ৫৫ হাজার বাংলাদেশী। মানবপাচারের সবচেয়ে জনপ্রিয় রুট এটি। ভূমধ্যসাগর দিয়েই ইউরোপে ঢুকতে হয়। গত সাত বছরে ২২ লাখ মানুষ অবৈধভাবে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। তিনি আরও বলেন, অনেকেই আবার অ্যাসাইলাম (আশ্রয়) চেয়েছেন। এ সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। দেড় থেকে দুই লাখ। যারা অবৈধভাবে ইউরোপ পাড়ি দেন তাদের অধিকাংশের বয়স ৩১ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। এদের সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ। এরপর আছেন ৩৬ থেকে ৪০ বছর বয়সীরা। তাদের সংখ্যা ২১ শতাংশ।
এমন মানবপাচার রোধে আমরা দুই ধরনের সুপারিশ করছি। প্রথমত, সবাই কিন্তু বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন না। ফরিদপুর, সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলের মানুষই বেশি যাচ্ছেন। যারা কিনা জেনে-শুনে-বুঝে অনেকেই পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা খরচা করে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে যারা যাচ্ছেন বা তাদের পরিবার যদি দায়িত্বশীল, সচেতন না হন তত দিন পর্যন্ত কিন্তু মানবপাচার ঠেকান সম্ভব হবে না। একটি দুর্ঘটনার পর দু-একটি অভিযান পরিচালনা করলেই চলবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সারাবছরই অভিযান পরিচালনা করতে হবে সমন্বিতভাবে। কারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেশীয় চক্রের সঙ্গে মানবপাচারে জড়িত আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিকভাবেই কঠোর ও জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে।
স্পেনে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর (শ্রম) সূত্র জানান, সাগরপথে লিবিয়া, আলজেরিয়া থেকে ইউরোপে এই ধরনের দুর্গম পথে যাত্রা অত্যন্ত বিপদসংকুল। দালালের প্ররোচনায় এই ঝুঁকিপূর্ণ সাগরপথে পা না বাড়ানোর জন্য তিনি প্রবাসীদের অনুরোধ করেন।
অভিবাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশী কর্মীদের পশ্চিম ইউরোপ কিংবা পূর্ব ইউরোপে যাওয়ার সংখ্যা খুবই নগণ্য। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে এটা খুবই কম। সারা বিশ্বে এখন দক্ষ শ্রমিকের ব্যাপক চাহিদা। এ চাহিদা মেটাতে ইউরোপের দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নত দেশগুলো বিভিন্ন খাতে দক্ষ লোকবল নিচ্ছে। তারা বলছেন, ইউরোপ দক্ষ অভিবাসীদের গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে বিভিন্ন দেশের লোকজন প্রতিযোগিতা করে ইউরোপ যাচ্ছে। এ জায়গায় বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ইউরোপের বাজার দখল না করার ব্যর্থতা রয়েছে।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল বলেন, ‘ইউরোপের প্রায় সব দেশেই শ্রমিকরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে আত্মীয়স্বজন কিংবা দালালের মাধ্যমে যান। যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের এমইউ (সমঝোতা স্মারক) আছে, সেটাও সফল হচ্ছে না। ফলে এজেন্সি যার যার মতো করে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে। তাও অবৈধভাবে। ইউরোপে একটা বাজার যখন ওপেন হয়, তখন কী ধরনের শ্রমিক তারা চায়, কোন ক্যাটাগরিতে শ্রমিক চায় সেটা আমাদের বুঝতে হবে। স্কিল মাইগ্রেশনের জন্য যে ইনস্টিটিউশনাল সিস্টেম গড়ে ওঠার কথা, সেটা এখনো আমাদের গড়ে ওঠেনি। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংখ্যা আইওএমের তথ্য অনুসারে, প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা থেকে প্রচুর জনশক্তি ইউরোপের দেশগুলোতে গেলেও বাংলাদেশ থেকে এ সংখ্যা নগণ্য। কারণ, দক্ষ জনশক্তির অভাব।