এই রোদ এই বৃষ্টি, থেমে থেমে বাড়ছে বৃষ্টি- এমন আবহাওয়ায় দেশজুড়েই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। তার সাথে বাড়ছে মৃত্যুও। ডেঙ্গুর কারনে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বাড়ায় জনমনে ভর করেছে আতংক। মশাবাহিত এই রোগ বাড়ার পেছনে চলমান আবহাওয়াকে দায়ী করলেও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশার নিধন হচ্ছেনা। সরকারী-বেসরকারী সংস্থাগুলো মশার নিয়ন্ত্রনও করতে পারছেনা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসেবে, গত ১০ দিনে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪ হাজার ৯৫৫ জন। এ সময়ে এই রোগটিতে মৃত্যু বরণ করেছেন ২৯ জন। অধিদফতরের হিসেব শুধুমাত্র সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হওয়ার পর পাওয়া পরিসংখ্যান। হাসপাতালের বাইরে থাকা রোগীদের সংখ্যা তাদের হাতে নেই। যার কারণে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়াসহ এ রোগে মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান আরও বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনায় সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বিশেষায়িত হাসপাতালের পরিচালক, জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক, সিভিল সার্জন, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে জরুরি ১২ নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

চলতি বছরে আক্রান্ত ৪১ হাজার ছাড়াল : গতকাল শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদফতর হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গুবিষয়ক তথ্যে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যু হয়নি। আর এই সময়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ৩৮২ জন। এর আগের দিন শুক্রবারও কার মৃত্যু হয়নি এবং আক্রান্ত হয়েছিল ২৪৮ জন। এর আগে টানা পাঁচ দিন ধরে ছয়শ’র বেশি মানুষ আক্রান্ত হন। এই নিয়ে চলতি মাসের ২০ দিনে মোট আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯ হাজার ৬১৫ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৪৫ জনের। সব মিলিয়ে এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যু হয়েছে ১৬৭ জনের এবং আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪১ হাজার ৯১ জন।

সূত্র মতে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৭৮ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৭৬ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৬৬ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৮ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭১ জন, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২১ জন এবং রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৭ রোগী ভর্তি রয়েছেন।

অধিদফতরের তথ্যমতে, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে জুলাই মাসে। এ ছাড়া জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন, এপ্রিলে সাতজন, মে মাসে তিন জন, জুন মাসে ১৯ জন, আগস্ট মাসে ৩৯ জন মারা যান। ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মারা গেছেন ২৩ জন। মার্চ মাসে কোনো রোগীর মৃত্যু হয়নি। এছাড়া এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে জুলাই মাসে সবচেয়ে বেশি, ১০ হাজার ৬৮৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। জানুয়ারিতে ১১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন, এপ্রিলে ৭০১ জন, মে মাসে ১৭৭৩ জন, এ ছাড়া জুন মাসে ৫৯৫১ জন, অগাস্টে ১০ হাজার ৪৯৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫২০৬ জন রোগী। ডেঙ্গু নিয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ১৭৯২ জন রোগী। তাদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৭৪৬ জন, ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ১০৪৬ জন।

জানা গেছে, ২০০০ সাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য রাখে । এর মধ্যে ২০২৩ সালে এ রোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ১৭০৫ জনের মৃত্যুও হয় ওই বছর। আর ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট ৫৭৫ জনের মৃত্যু হয়।

এই রোদ এই বৃষ্টি আবহাওয়া : চলতি মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে গত দুই মাসের তুলনায়। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যাও এ মাসে বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রোদ, এই বৃষ্টি- এমন আবহাওয়াই এডিস মশার বিস্তারে খুবই সহায়ক। এ কারণে এ মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। রোগী বাড়লে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ে। আগামী অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুর এমন ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা থাকতে পারে। এবারের ভয়াবহতা ২০১৯ সালের মতো হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

চলতি বছরে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে শুরু করে জুন থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থেমে থেমে বৃষ্টিতে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে যায়। রাস্তায় কিংবা বাসাবাড়ির আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা পলিথিন, বিভিন্ন খাবারের প্যাকেট, ডাবের খোসাসহ বিভিন্ন আধারে পানি জমে যায়। এখন সেখান থেকেই এডিস মশার বিস্তার হচ্ছে।

কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, মাঝে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছু কম ছিল। বৃষ্টির কারণে এখন বাড়ছে। অক্টোবরেও বাড়বে। তিনি বলেন, ২০২৩ সালের মতো পরিস্থিতি না হলেও ২০১৯ সালের মতো হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ১২ নির্দেশনা : ডেঙ্গু রোগীদের জরুরি ভিত্তিতে এনএসওয়ান পরীক্ষা করতে হবে। এনএসওয়ান/এন্টিজেন কিটের জন্য সিএমএসডি অথবা সিডিসির সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। ভর্তি ডেঙ্গু রোগীদের যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হবে হাসপাতালে সেসব পরীক্ষা সার্বক্ষণিক করার ব্যবস্থা করতে হবে। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় সাধারণত যেসব ওষুধ এবং অন্য চিকিৎসা উপকরণের প্রয়োজন হয়, হাসপাতালে সেগুলোর প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। ভর্তি সব ডেঙ্গু রোগীকে হাসপাতালের একটি নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে বা কক্ষে বা স্থানে রাখতে হবে। ভর্তি ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য মেডিসিন, শিশু ও প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে বোর্ড গঠন করতে হবে। এই বোর্ডের তত্ত্বাবধায়নে মেডিকেল অফিসার/রেসিডেন্ট/প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকদের একটি নির্দিষ্ট দল তৈরি করতে হবে যারা শুধু ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগীদের চিকিৎসা দেবেন। বহির্বিভাগে আসা রোগীদের মধ্যে যাদের ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত বলে সন্দেহ হবে, তাদের একটি নিদিষ্ট কক্ষে ওপরে উল্লিখিত বিশেষজ্ঞ বোর্ড এবং চিকিৎসকরা চিকিৎসা প্রদান করবেন। ভর্তি ডেঙ্গু রোগীদের আইসিইউর প্রয়োজন হলে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। ডেঙ্গুর তথ্য সংরক্ষণ ও প্রেরণের জন্য একজন নার্সকে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। ডেঙ্গু রোগী মারা গেলে সংক্ষিপ্ত তথ্য ৬ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালের পরিচালক/তত্ত্বাবধায়ক এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালককে (হাসপাতাল ও সিডিসি) লিখিতভাবে জানাতে হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিশদ তথ্য যাচাই করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও সিডিসি) বরাবর পাঠাতে হবে। হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ককে মেয়র (সিটি করপোরেশন/পৌরসভা) বরাবর হাসপাতালের চারপাশে মশক নিধন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনার জন্য চিঠি দিতে হবে। প্রতি শনিবার সকালে হাসপাতালে পরিচালক/তত্ত্বাবধায়ক/সিভিল সার্জনের সভাপতিত্বে ডেঙ্গু সমন্বয় সভা করতে হবে। অন্যান্য জেলা হাসপাতাল প্রয়োজনে এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পারবে।