আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন করে মাঠ প্রশাসন সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তারই অংশ হিসেবে উপসচিবদের মধ্য থেকে জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে পদায়নের জন্য নতুন ফিট লিস্ট তৈরি শুরু করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

সূত্র জানায়, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে খোদ মন্ত্রণালয় থেকে মাঠ প্রশাসনে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার। সচিবের সব শূন্য পদ পূরণ করা হবে। জেলায় ডিসি, এডিসি, ইউএনও পরিবর্তন করা হবে। একই সঙ্গে পুলিশ সুপার ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পর্যায়েও পরিবর্তন হবে বলে জানা গেছে। ’চলতি নবেম্বর মাসের মধ্যে এই পরিবর্তন আসবে বলে প্রশাসনের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। ইতোমধ্যেই প্রশাসনে ধীরে ধীরে রদবদল হচ্ছে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসক পদে পদায়নের জন্য ২৯ অক্টোবর ১০ জন উপসচিবের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। ৩০ অক্টোবর ২০ জন উপসচিবের সাক্ষাৎ নেওয়া হয়েছে। আর ৩১ অক্টোবর গতকাল শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আরও ১০ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। যে ৪০ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই বিসিএস ২৯ তম ব্যাচের কর্মকর্তা।

গত ২৯ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে নির্বাচনি প্রস্তুতি-সংক্রান্ত বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, সবচেয়ে ফিট কর্মকর্তাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পদায়ন করা হবে। তবে নিজ জেলা বা শ্বশুরবাড়ির এলাকায় কাউকে পদায়ন করা হবে না। তাদের কোনো আত্মীয়স্বজন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কি না পদায়নের ক্ষেত্রে সে বিষয়েও লক্ষ্য রাখা হবে। ১ নবেম্বর এগুলো শুরু হচ্ছে।

প্রেস সচিব বলেন, মাঠ প্রশাসনে, বিশেষ করে ডিসি, এডিসি, ইউএনওসহ বিচারিক দায়িত্বে এমন কাউকে পদায়ন করা হবে না; যিনি গত তিনটি নির্বাচনি কাজে যুক্ত ছিলেন। ন্যূনতম ভূমিকা থাকলেও তাকে এই নির্বাচনে দায়িত্বে রাখা হবে না। পদায়নের ক্ষেত্রে কর্মকর্তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, শারীরিক যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা, গণমাধ্যমে অনিয়মের প্রতিবেদন হয়েছে কি না, তা দেখা হবে।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, জেলা প্রশাসক নিয়োগ বা পদায়নে সাধারণত কিছু নীতিমালা অনুসরন করা হয়। প্রথমে জেলা প্রশাসক হওয়ার উপযুক্ততা যাচাইয়ে উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে একটি ফিট লিস্ট তৈরি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ওই ফিট লিস্ট থেকে কর্মজীবনের দক্ষতা, জেষ্ঠতা ও অন্যান্য যোগ্যতার ভিত্তিতে ডিসি নিয়োগ করা হয়ে থাকে। একজন ডিসি একটি জেলার প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ওই জেলার তিন শতাধিক কমিটির প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। নির্বাচনের সময় ডিসিরা সাধারণত রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার টেরিটোরিতে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পুরো দায়িত্ব তার ওপর দেওয়া হয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ৬৪ জেলায় ডিসি নিয়োগ করা যায়, এমন একটি ফিট লিস্ট ইতিমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের হাতে রয়েছে। এরপরও সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে আরও কর্মকর্তাদের বাছাই করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে নিরপেক্ষতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের হাতে বেশি অপশন থাকে। সে অনুযায়ী নতুন ফিট লিস্ট তৈরি করা হচ্ছে। নবেম্বরের মধ্যেই বেশিরভাগ ডিসি পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। প্রথমে মাঠ প্রশাসনের পদায়ন নিয়ে আলোচনা হয়। ১ নভেম্বর (আজ শনিবার)থেকে মাঠ প্রশাসন গোছানোর কাজ শুরু হচ্ছে।

শফিকুল আলম বলেন, ‘মাঠ প্রশাসনে যেন এমন পদায়ন না হয়, যারা গত তিনটি নির্বাচনে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেখানে তারা রিটার্নিং অফিসার, পোলিং অফিসার বা অ্যাসিস্টেন্ট রিটার্নিং অফিসার হিসেবে থাকুন না কেন, গত তিন নির্বাচনে তাদের যদি ন্যূনতম ভূমিকা থাকে তাহলে যেন পদায়ন না হয় এ বিষয়ে বলা হয়েছে।’

প্রেস সচিব বলেন, ‘ইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এরই মধ্যে পদায়নের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পদায়নের ক্ষেত্রে কী কী ক্রাইটেরিয়া হবে এসব বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। যিনি সবচেয়ে বেশি ফিট তার ক্রাইটেরিয়ায় আগের পোস্টিং, রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড, কর্মদক্ষতা, তার বিরুদ্ধে কোনও নিউজ আছে কিনা অনেকগুলো বিষয় দেখা হচ্ছে। কতটুকু ফিট এবং যিনি ফিট তাকে দেওয়া হবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায়। এগুলো র‌্যান্ডোমলি নির্বাচন করা হবে।’

শফিকুল আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আমাদের সেরাটা আশা করতে হবে কিন্তু সবচেয়ে খারাপের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’’ যেকোনও পরিস্থিতির জন্য যেন প্রস্তুত থাকি আমরা। পদায়নের ক্ষেত্রে নিজ জেলায় কেউ যাবেন না। বিশেষ করে, আত্মীয় কিংবা শ্বশুরবাড়ি যদি থাকে সেখানে পোস্টিং হবে না। আরেকটি বিষয় দেখা হবে, পদায়নের ক্ষেত্রে নিকট আত্মীয় কেউ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে কিনা। আর এ বিষয়ে যে কাজ সেটি ১ নবেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে সব সরকারই মাঠ প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়। সময় কম, দ্রুতই এই কাজটি করতে হবে। যাকে দায়িত্ব দেবে সরকার তারও ওই এলাকা চিনতে হবে।

এলাকা বিষয়ে পরিকল্পনা সাজাতে হবে। রদবদলের ক্ষেত্রে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও সাহসী কর্মকর্তাদের মাঠ প্রশাসনে নিয়োগ দিতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা দলের তদবির শুনলে হবে না।

প্রশাসনের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন কাউকে এই নির্বাচনে রাখতে চাচ্ছে না সরকার। সেভাবেই প্রস্তুতি চলছে। খালি থাকা কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নতুন সচিব নিয়োগ দেওয়া হবে। এ ছাড়া রদবদলও হতে পারে। মাঠ প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদ জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদেও ব্যাপক রদবদল করা হবে। ইতোমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে নতুন সচিব যোগ দিয়েছেন। সূত্র মতে, জনপ্রশাসনের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগে (এপিডি) নিয়োগ পেলে রদবদল আরও দ্রুত গতিতে কাজ এগোবে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই মাঠ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে কর্মকর্তাদের রদবদল করা হবে। নির্বাচন কমিশন চাইলে তফসিল ঘোষণার পরও রদবদল হবে। প্রশাসনে ২৪, ২৫ ও ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তারা ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইতোমধ্যেই ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তারা যুগ্ম সচিব হয়েছেন তাদের মাঠ থেকে তুলে আনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্বাচনের আগে নতুন ডিসি দেওয়া হবে।

পর্যায়ক্রমে ২৪ ব্যাচের ডিসিদের তুলে আনার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। সেক্ষেত্রে কয়েকজন ২৮তম বিসিএসের কর্মকর্তাকে মাঠে পাঠানো হবে। নির্বাচনের সময় ডিসিরা রিটার্নিং অফিসার এবং ইউএনও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হন। বর্তমানে ৩৪, ৩৫ এবং ৩৬ ব্যাচের কর্মকর্তারা ইউএনও হিসেবে আছেন। অনেক জেলায় ৩৪ এবং ৩৫ ব্যাচের কর্মকর্তারা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের দায়িত্বেও আছেন।

সূত্র জানায়, খুব দ্রুতই মাঠ থেকে ৩৪ ব্যাচের সব ইউএনওদের তুলে আনা হবে। সেখানে ৩৫ ও ৩৬ ব্যাচের কর্মকর্তা পাঠানো হবে। একই সঙ্গে নির্বাচনের আগে ৩৭ ব্যাচ থেকেও ইউএনও মাঠে পাঠানো হবে। অনেক ইউএনওর উপজেলা বদল করা হবে। ইতোমধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে ইউএনওদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ১১ নবেম্বর পর্যন্ত এই প্রশিক্ষণ ব্যাচভিত্তিক হওয়ার কথা রয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনের আগে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়েও বড় রদবদল আসবে। বর্তমানে ২৪, ২৫ এবং ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তারা মাঠে এসপি হিসেবে আছেন। এর মধ্যে ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তাদের তুলে আনা হবে। সূত্র জানায়, নির্বাচনের আগে ২৮ ব্যাচের দু-চারজনকে এসপি হিসেবে মাঠে পাঠানো হবে। এ ছাড়া মাঠে থাকা কর্মকর্তাদের জেলা বদল করা হতে পারে।