মোহাম্মদ জাফর ইকবাল, সুনামগঞ্জ (হাওড়) থেকে ফিরে : হাওড়, পাহাড়, নদী ও লেকের অপার সৌন্দর্যের নাম ভারতের মেঘালয় রাজ্যের কোলঘেঁষা জেলা সুনামগঞ্জ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সব কিছুই একসঙ্গে ধরা দেয় এই জেলায়। এর মধ্যে টাঙ্গুয়ার হাওড় সৌন্দর্যে অনন্য এক জলাভূমি। পর্যটকদের কাছে অতিপ্রিয়। ভরা বর্ষায় সেই রূপ উপচে পড়ে। হাওড়ের স্বচ্ছ পানিতে জলকেলি, পানি আর জোছনার মায়াবী খেলায় তনুমন দুটোই জুড়িয়ে যায়। রাতে জ্যোৎস্নার আলো আর হিমেল হাওয়া এযেন এক স্বর্গসুখের অনুভূতি। এমন মনোরম দৃশ্য মানবজীবনকে সার্থক করে তোলে। মন চায় হাওড়ের বুকে হারিয়ে যেতে। শেষ বিকেলে উত্তরের সবুজ মেঘালয় পাহাড়, আকাশে থাকা মেঘের ছায়া অন্য রকম এক মায়ায় বিলিয়ে দেয়, মুগ্ধতা ছড়ায় চারপাশে। টাঙ্গুয়ার হাওড় ও আশপাশের এলাকা ঘুরে তাই মুগ্ধতা নিয়ে ফেরেন পর্যটকেরা। ঈদ বা যে কোনো ছুটিতে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে পর্যটকদের ঢল নামে। এই হাওড়ে এলে পর্যটকেরা বাড়তি হিসেবে জাদুকাটা নদী, বারিক টিলা, শহীদ সিরাজ লেক (নীলাদ্রি লেক), শিমুলবাগান ও লাকমাছড়া ঘুরে যান। পুরো এলাকা কাছাকাছি, ছবির মতো সুন্দর।

টাঙ্গুয়ার হাওড়। বর্ষা ও শুকনা মৌসুমে দুই রূপ চোখে পড়ে তার। বর্ষায় দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। এই জলরাশির ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে হিজল ও করচগাছের বাগান। তখন হাওরের গ্রামগুলোকে মনে হয় ছোট ছোট দ্বীপ। এছাড়া পুরো জেলা জুড়ে রয়েছে চোখ জুড়ানো লাল শাপলা। যেন এসব পানির ওপর ভাসছে। হাওড়ের উত্তরে সবুজে মোড়া মেঘালয় পাহাড়। নীল আকাশে সাদা মেঘের ওড়াউড়ি। বিকেলের রোদে মেঘের ছায়া পড়ে নীল হয়ে ওঠে হাওড়ের পানি। তখন পুরো এলাকাকে ছবির মতো মনে হয়।

‘হাওড়কন্যা’ সুনামগঞ্জের পরিচিতির মূলে আছে টাঙ্গুয়ার হাওর। এটি দেশের সবচেয়ে বড়, সুন্দর ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময় জলাভূমি। সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে জেলার তাহিরপর ও ধরমপাশা উপজেলায় এ হাওড়ের অবস্থান। দুই উপজেলার চারটি ইউনিয়নের ১৮টি মৌজা মিলে হাওড়ের আয়তন ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর। হাওরে ছোট-বড় ৫৪টি বিল আছে। এর ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য খাল ও নালা। বর্ষায় সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তখন হাওর রূপ নেয় সমুদ্রে। হাওড়ের উত্তরে ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা ৩৮টি ঝরনাও মিশেছে এই টাঙ্গুয়ার হাওড়ে। কখনো আকাশের মতো নীল, কখনো আয়নার মতো স্বচ্ছ, এমন স্নিগ্ধ রঙে রাঙা পানিতে টইটুম্বর হাওড়-বাঁওড়। দূরে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়, ঝরনা থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ পানি, অগণিত পাখির কলতান আর করচ-হিজল বনের অপরূপ সৌন্দর্যের সমাহার দেখা যাবে শুধু টাঙ্গুয়ার হাওড়েই।

সুনামগঞ্জ শহরের সুরমা নদীর ঘাট থেকে সরাসরি কিংবা তাহিরপুর উপজেলা সদরের ঘাট থেকে নৌকায়, হাউসবোটে করে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে আসেন পর্যটকেরা। আবার নেত্রকোনা থেকেও কিছু নৌকা আসে পর্যটকদের নিয়ে। একসময় হাওরে রাত্রিযাপনের প্রচলন না থাকলেও এখন হাওড়ে নৌকায়, হাউসবোটে রাত যাপন করেন অনেকেই। নৌকায় খাওয়াদাওয়া, গানবাজনা সবই হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত নৌকাগুলো পর্যটকদের নিয়ে অবস্থান করে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার এলাকায়। এরপর এগুলো পর্যটকদের নিয়ে যায় হাওড়ের উত্তরপাড়ে, মেঘালয় পাহাড়ের কোলে টেকেরঘাটে। সেখানে প্রতিদিন শত শত নৌকায় রাত যাপন করেন পর্যটকেরা। সেখান থেকে পাশে শহীদ সিরাজ লেক (নিলাদ্রী), বারিকের টিলা, শিমুলবাগান আর জাদুকাটা নদের অপার সৌন্দর্য ঘুরে দেখেন তঁরা।

বছরের প্রত্যেকটা মৌসুমে যেমন হাওড় সাজে ভিন্ন রূপে, ঠিক তেমনি প্রতি বেলাতেও এর সাজ একেক রকম। ভোরবেলা হাওর থাকে সুনসান এবং স্নিগ্ধ, কিছুক্ষণ পর হাওড় হয়ে ওঠে পাখির কলকালিতে পূর্ণ। দুপুর ও বিকেলে দেখা যায় হাওড় ও এর চারপাশের বাসিন্দাদের যাপনচিত্র। আর সূর্য ডোবার সময়ে সম্পূর্ণ হাওড় ঢেকে যায় সোনালি রঙের চাঁদরে। রাতের ঝকঝকে আকাশে মিটমিট করে তারার মেলা। সৌন্দর্যের এই আমেজে মেতে ওঠেন নৌকার মাঝি নিজেও। তাই সন্ধ্যার পর এই হাওড়ে প্রায়ই বসে বাউলগানের আসর।

একসময় এই হাওড়ে শুধু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেই ঘুরতে যাওয়া সম্ভব হতো। কিন্তু বর্তমানে থাকার জন্য আধুনিক ও আরামদায়ক নৌকা প্রচলিত হওয়ায় এখন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও অনায়াসে এই হাওড় ঘুরে আসা সম্ভব। এ ছাড়া কেউ যদি স্বল্প বাজেটের মধ্যে ঘুরে আসতে চান, সে জন্যও আছে মাত্র দুই হাজার টাকার মধ্যে ট্যুরের ব্যবস্থা। তা ছাড়া কেউ চাইলে পুরো একটি নৌকা ভাড়া করে নিতে পারবেন কিংবা অন্যদের সঙ্গেও শেয়ার করেও ট্যুরে যেতে পারবেন।

হাউসবোট পরিচালনায় যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব বোটে প্যাকেজ হিসেবে হাওড়ে পর্যটকদের নেওয়া হয়। অনলাইনে অনেকেই প্রচার করেন। হাওড়ে মূলত দুই দিনের প্যাকেজ হয়। সকালে পর্যটকেরা বোটে উঠবেন, সারা দিন ঘুরবেন। বোটগুলো প্রথমে যায় হাওড়ের পর্যবেক্ষণ টাওয়ার এলাকায়। এখানে পর্যটকেরা ছোট ছোট নৌকায় ঘুরে বেড়ান করচগাছের বাগানের ভেতর। অনেকেই জলকেলি করেন। এখানে দুপুরের খাবার সেরে বোটগুলো রওনা হয় হাওড়ের উত্তরপাড়ে মেঘালয় পাহাড়ে পাদদেশে থাকা টেকেরঘাট এলাকায়। টেকেরঘাট এলাকায় বোটেই রাত যাপন করেন পর্যটকেরা। পরদিন আশপাশের এলাকা ঘুরে আবার হাওড় থেকে ফিরে আসেন। অনেক বোট সুনামগঞ্জ পৌর শহরের সুরমা নদীর বিভিন্ন ঘাট থেকে যায়। আবার কিছু যায় তাহিরপুর উপজেলার আনোয়ারপুর এবং উপজেলা সদর থেকে। শহর থেকে যেগুলো ছাড়ে, সেখানে পর্যটকেরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে বোটে ওঠেন। অন্যরা তাহিরপুর গিয়ে তারপর যান।

বর্ষাকালে টইটুম্বুর থাকে হাওড়। এই সময়ে পর্যটকদের উপস্থিতি থাকে সবচেয়ে বেশি। এসময় এলাকার নৌকাগুলোর মালিক-শ্রমিকেরাও ব্যস্ত সময় পার করেন। হাওড়ের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের পাশে গোলাবাড়ি গ্রামে পর্যটকদের থাকার জন্য ‘হাওর বিলাস’ নামে একটি গেস্টহাউস আছে খসরু মিয়ার। এখানে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তিনি জানান, ‘হাওড়ের পরিবেশও ভালা। আমরা পর্যটকদের অপেক্ষায় আছি।’

জানা গেছে, প্রতিটি পর্যটকবাহী নৌযানকে উপজেলা প্রশাসনের কাছে নিবন্ধন করে হাওড়ে যেতে হয়। তখন তাদের নির্দেশনা দেয়া হয় এই বলে যে, হাওড়ের প্রকৃতি-পরিবেশের কোনো ক্ষতি করা যাবে না। পানিদূষণ হয়, এমন কোনো বর্জ্য ফেলা যাবে না। পর্যটকদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া থাকে। সূত্র জানায়, টাঙ্গুয়ার হাওড়, নিলাদ্রী লেক, বারেকের টিলা, শিমুল বাগানকে ঘিরে কমপক্ষে হাউজবোটসহ ২ শতাধিক বোট চলাচল করলেও জেলা প্রশাসন থেকে ৯০টির কমবেশি হাউজবোট নিবন্ধন নিয়েছে।

জানা গেছে, ১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওড়কে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তখনই অবসান হয় দীর্ঘ ৬০ বছরের ইজারাদারির। ২০০০ সালে জানুয়ারিতে এ হাওড়কে ‘রামসার সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর হাওড়ের জীববৈচিত্র রক্ষায় কাজ করে আইসিইউএন। হাওড় এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, সম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে ২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ২০০৩ সালের ৯ নভেম্বর থেকে হাওড়ের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন। সুইস অ্যাজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন (এসডিসি) এবং আইসিইউএন ২০০৬ সালের ডিসেম্বর থেকে টাঙ্গুয়ার হাওড় সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা’ প্রকল্প পরিচালনা করে। স্থানীয় লোকজনের কাছে হাওড়টি নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল নামেও পরিচিত। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট। টাঙ্গুয়ার হাওর দক্ষিণ এশিয়ার সেরা জায়গাগুলোর একটি। টাঙ্গুয়ার হাওর ইউনেস্কো ঘোষিত রামসার সাইট, এখানে সব ধরনের পাখি ও মাছ মারা নিষেধ। তাই এখানের জীববৈচিত্র্য অন্য সব জায়গার চেয়ে আলাদা। এখানে অনেকেই যান পাখি গুনতে, পাখির কল-কাকলি শুনতে ও বিভিন্ন গবেষণার কাজে।

দিনাজপুর থেকে আসা পর্যটক অসাদুল করিম দৈনিক সংগ্রামের কাছে বলেন, বন্ধু-বান্ধব থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর সম্পর্কে জানতে পারি। তারপর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে এসেছি। টাঙ্গুয়ার হাওরের সৌন্দর্যের কথা মুখে বলে বুঝানো সম্ভব না। এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে হাওড়ে আসতে হবে। এক কথায় অসাধারণ এ হাওড়ের সৌন্দর্য।

ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা সাংবাদিক হাসান বলেন, মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত সুনামগঞ্জ জেলার টাঙ্গুয়ার হাওড়, নিলাদ্রী লেক, বারিকটিলা শিমুলবাগানসহ সবকটি পর্যটনকেন্দ্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। আমি প্রতিবছরই হাওড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসি।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড়সহ আশপাশের পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটকদের ভ্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভবিষ্যতে এটি আরও বাড়বে বলে আমি মনে করি। তিনি বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তা ও হাওড়ের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষার বিষয়টাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও পর্যটকদের নিরাপত্তায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিয়োজিত রয়েছেন।