জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হামলার ঘটনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাক্ষী দিয়েছেন রংপুরের এনটিভির সাংবাদিক এ কে এম মঈনুল হক ও রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিনা মূর্মু। সাক্ষ্যগ্রহণের একপর্যায়ে চতুর্থ সাক্ষী সাওতাল রিনা মূর্মু আদালতে বলেছেন, আবু সাঈদকে হত্যার সময় দুই পুলিশ আমির হোসেন ও সুজন চন্দ্র রায় গুলী করে, আমি নিজের চোখে দেখেছি। এ হত্যা মামলায় শেখ হাসিনা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের বিচার চাই।

গতকাল বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে রিনা মূর্মু এ মামলায় সাক্ষ্যদানের জবানবন্দিতে এসব কথা বলেন। বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে এ শুনানি হয়। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেনÑবিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

গতকাল বুধবার ট্রাইব্যুনালে দুজন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ক্যাম্পাসে আবু সাঈদের ওপর হামলার ঘটনার প্রত্যক্ষ্যদর্শী তারা। এ মামলায় এ পর্যন্ত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পাঁচজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন।

গতকাল রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন সাক্ষীদের জেরা করেন। পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ১৭ আগস্ট দিন ধার্য করেছেন আদালত।

চতুর্থ সাক্ষীর জবানবন্দিতে রিনা বলেন, আমি রিনা মুরমু, ধর্ম খ্রিষ্টান। সাঁওতাল বংশের লোক। আমি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সে অর্থনীতির ছাত্রী ছিলাম। ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই ভিসি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচি পালন করি আমরা। মর্ডান মোড়ের ভিসি অফিসে যাওয়ার সময় পুলিশ বাধা প্রদান করে। আমি আন্দোলনে প্রথম সারিতে ছিলাম। শেখ হাসিনা ছাত্র-ছাত্রীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলার প্রতিবাদে ১৪ জুলাই রাতেই মেয়েদের হল থেকে আমিও মিছিল নিয়ে বের হই। এ ছাড়া প্রশাসনের লাগানো গেটের তালা ভেঙে ১৫ জুলাই বিকেল ৪টায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং গেটে প্রতিদবাদ সমাবেশ হয়। একই স্থানে ছাত্রলীগও পাল্টা কর্মসূচি দেয়। এ সময় তাদের হাতে অস্ত্র ছিল। ওইদিন তাদের অস্ত্রের আঘাতে কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী আহত হয়। পরদিন ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা কর্মসূচি দেয়। রংপুর জেলা স্কুলের সামনে বিভিন্ন স্কুলের ছাত্ররা ও মিছিল বের করে। সব মিছিল একত্রিত হয়ে পার্ক মোড়ে অবস্থান নেয়।

জবানবন্দিতে সাক্ষী রিনা মূর্মু বলেন, মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১নং গেটে পৌঁছলে পুলিশের সঙ্গে বাগবিত-া হয়। একপর্যায়ে পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। এ সময় ছাত্রলীগ আমাকে লাঠি দিয়ে পায়ে আঘাত করে। ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ একাধারে গুলী করে যাচ্ছিল। এ সময় আবু সাঈদ রাস্তার মাঝখানে এসে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ায়। তখন দুজন পুলিশ আবু সাঈদকে লক্ষ্য করে সরাসরি গুলী করে। আমি তাদের নাম জানতে পারিÑআমির হোসেন ও সুজন চন্দ্র রায়। আমি নিজের চোখে গুলী করতে দেখি।

রিনা মুর্মূ বলেন, সেদিনের ঘটনায় আমি নিজেও আহত হয়েছিলাম। জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, আবু সাঈদকে হত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনা, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং তখনকার পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দায় এড়াতে পারেন না। আমি তাদের বিচার চাই।

রিনা মূর্মুর জবানবন্দি শেষে তাকে জেরা করেন শেখ হাসিনার আইনজীবী আমির হোসেন। জেরায় তিনি বলেন, আপনি বলেছেন আবু সাঈদকে পুলিশ গুলী করেছে। কতটুকু দূরত্ব থেকে গুলী করেছিল? জবাবে সাক্ষী রিনা মুর্মূ বলেন, ২০ থেকে ২৫ হাত দূর হবে।

আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, ঘটনার সময় আপনি কাকে দেখেছেন?

সাক্ষী রিনা মুর্মূ বলেন, পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ছিল। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মচারী ছিল।

আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, আপনি এখানে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে অসত্য সাক্ষ্য দিলেন। জবাবে সাক্ষী রিনা বলেন, এটা সত্য নয়।

এ সময় আইনজীবী আমির হোসেন সাক্ষীকে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে নিলে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম তাকে বাধা দেন।

এ সময় শেখ হাসিনার আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, আমাকে (শেখ হাসিনা) ফাঁসি দিয়ে দিবেন? জবাবে আদালতের বিচারক বলেন, ফাঁসি যেন দিতে না হয় সেজন্যই তো প্রত্যেক পয়েন্ট নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণের জন্য আপনাকে নিয়োগ করা হয়েছে।

জবাবে শেখ হাসিনার আইনজীবী বলেন, চেষ্টা করছি।

এ পর্যায়ে সাক্ষী ও জেরা শেষে মুলতবি করা হয়।

গত ১০ জুলাই এই মামলার রাজসাক্ষী হন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। ট্রাইব্যুনালের আদেশে তাকে দোষ স্বীকারের শর্তে ক্ষমা ঘোষণা করা হয়।

গত ১ জুন এই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। শেখ হাসিনার পাশাপাশি আসামি করা হয় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে। প্রসিকিউশন তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনেন। অভিযোগগুলো হলোÑ

প্রথম. গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের রাজাকারের বাচ্চা ও রাজাকারের নাতিপুতি উল্লেখ করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করে। গুলী করে দেড় হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। আহত হন প্রায় ২৫ হাজার।

দ্বিতীয়. হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে সেই নির্দেশ কার্যকর করেন। গত বছরের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল এবং ১৮ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে কথা বলেন শেখ হাসিনা। দুজনের সঙ্গে কথোপকথনের পৃথক অডিও রেকর্ড থেকে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে মারণাস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।

শেখ হাসিনার সেই নির্দেশ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির মাধ্যমে সব বাহিনীর কাছে দেওয়া হয়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তার অন্যান্য অঙ্গসংগঠন এবং ১৪ দলীয় জোটের কাছেও এই নির্দেশ যায়। সেই নির্দেশের আলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এর দায়ে তাদের (হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুন) বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (সর্বোচ্চ দায়) আওতায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।

তৃতীয়. রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি আসাদুজ্জামান ও মামুনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

চতুর্থ. রাজধানীর চানখাঁরপুলে আন্দোলনরত নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায়ও শেখ হাসিনার পাশাপাশি ওই দুজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

পঞ্চম. শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুনের বিরুদ্ধে আশুলিয়ায় নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনায়ও অভিযুক্ত করা হয়েছে।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে মোট চারটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২ জুলাই আদালত অবমাননার একটি মামলায় তাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদ- দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এটিই প্রথম কোনো মামলা, যেখানে হাসিনার কারাদ- হয়েছে।

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে অংশ গাজী এম এইচ তামিম ও মিজানুল ইসলাম, আব্দুস সাত্তার পালোয়ান প্রমুখ। শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন শুনানি করেন।