আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কোনো কর্মকর্তা যদি দলীয় আচরণ করেন, তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন।

গতকাল মঙ্গলবার সকালে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে শুরু সংলাপের সমাপনী বক্তব্যে তিনি এই হুঁশিয়ারি দেন। এদিকে বিশেষজ্ঞগন ইসিতে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়েছেন। এ সময় অন্য চার নির্বাচন কমিশনারসহ ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। নির্বাচন বিশেষজ্ঞের মধ্যে ছিলেন- ইসির সাবেক কর্মকর্তা মো. জকরিয়া, পর্যবেক্ষক সংস্থা ফেমার প্রেসিডেন্ট মনিরা খান, ইসির সাবেক কর্মকর্তা খন্দকার মিজানুর রহমান, মো. নুরুজ্জামান তালুকদার, মিহির সারওয়ার মোর্শেদ, শাহ আলম, মীর মোহাম্মদ শাহজাহান, মিছবাহ উদ্দিন আহমদ, মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী, মাহফুজা আক্তার।

সিইসি বলেন, আমরা ব্যাংক থেকে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নেওয়ার কথা বলছি। কারণ, সরকারি কর্মচারী যারা আছেন, প্রাইমারি স্কুলের টিচার বলেন, আর যাই বলেন, নিচের লেবেলে এরা তো দেখে কোন সরকার ক্ষমতায় আসবে। প্রমোশন হয় কি না, বদলি করে দেয় কি না, এমন একটা ভয় থাকে। তাই আমরা ব্যাংক, ট্যাংক এসব চিন্তা করেছিলাম।

তিনি বলেন, আমাদের কাছে নানা কারণে অভিযোগ আসছে, রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা, উই আর টেক কেয়ার অব দিস। আমরা তালিকা হয়তো নেব। যা করার আমরা করব মোটমুটিভাবে।

সিইসি বলেন, অন্তর্যামী হলেন আল্লাহতাআলা। এখন অন্তরের মধ্যে কোনো দলীয় মনোবৃত্তি আছে কি না, সেটা তো জানা সম্ভব না। তবে দলীয় দলদাসের মতো কাজ করতে পারবেন না, সেটা আমরা নিশ্চিত করব। কারও যদি রাজনৈতিক অভিলাষ থাকেও, সেটা বাস্তব কাজে প্রতিফলিত হবে না, সেটা আমরা নিশ্চিত করবো।

তিনি বলেন, আগে তো বলা হতো একটা পক্ষে কাজ করতে হবে। এখন তো সে রকম নির্দেশনা যাবে না। কোনো পক্ষে কাজ করলে অ্যাকশন নেওয়া হবে। এখনকার মেসেজ হলো এটা। এখন কারও পক্ষে কাজ করলে অ্যাকশন হবে। এই মেসেজ আমরা দিয়েছি, আরও দেব। সিইসি বলেন, নির্বাচন করার দায়িত্ব তো কেবল ইসির না। এটা জাতীয় দায়িত্ব। ভোটের সময় ইসির ক্ষমতা ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা পায়। আগে তো রাতে গিয়ে মোটিভেটেড করে কায়দা করে ভোটটা আদায় করে নেওয়া হয়েছে। এখন যত রকমের কার্যক্রম গ্রহণ করা সম্ভব আমরা নেব, যাতে দলীয় আচরণ না করতে পারে।

গত তিন নির্বাচনে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের প্রসঙ্গে টেনে তিনি বলেন, গত তিনটা নির্বাচনে যারা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের নিয়ে সবাই তো সন্দেহ পোষণ করে। তবে ভালো-খারাপ তো সবখানেই আছে। কিন্তু একদম অনেকে বলছেন, গত তিন নির্বাচনে যারা কাজ করেছেন, তারা যেন ধারেকাছে না আসতে পারে। এখন ১০ লাখ লোকের মধ্যে বাদ দিতে গেলে কম্বলই উজাড়। লোম বাছতে গিয়ে কম্বল উজাড়, আমার অবস্থা হয়েছে সে রকম।

সিইসি আরও বলেন, সুতরাং তাদের কিছু নিতে হবে। তবে তাদের নজরদারির মধ্যে রাখা হবে। মানুষ তো মানুষই। বিবেক আছে তো। সে তো পরিস্থিতি বুঝবে, কখন কোথায় কাজ করছে। কাজেই অনেকেই দেখবেন সঠিক আচরণ করছেন, ইনশাআল্লাহ।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়েছেন সংস্থাটির সাবেক কর্মকর্তারা। তারা বলেন, নিরপেক্ষতা ও প্রশাসনিক প্রস্তুতিই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মূল চাবিকাঠি। ভোটের আগে লোকবল নিয়োগে স্বচ্ছতা, মাঠ প্রশাসনে দলীয় প্রভাবমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি এবং নির্বাচনের দিন দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে এখন থেকেই পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক কর্মকর্তারা।

ইসির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. জকরিয়া জানান, ইসির একার পক্ষে এ কর্মযজ্ঞ সম্ভব নয়। ইসির কর্মকর্তা রয়েছে আড়াই হাজার, কিন্তু নির্বাচনে দরকার প্রায় ১০ লাখ লোকবল। সব ধরনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ভোটের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে। তাদের নিয়োগের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

তিনি বলেন, ‘লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা দেখতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান রয়েছে একেবারে দলীয়। ইসলামী ব্যাংক বা এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে লোকবল নিয়োগ করা হয়নি। এবারও এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। গত তিনটি নির্বাচনে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের এভয়েড করতে হবে, যাতে নির্বাচন অহেতুক প্রশ্নবিদ্ধ না হয়।’

সাবেক এ কর্মকর্তা ২০০৭ সাল পযন্ত ইসিতে কর্মরত ছিলেন। বর্তমান ইসির আমলে কারিগরি কমিটিতেও যুক্ত রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বৈধ ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে, সীমান্ত পথে আসা অস্ত্র, নকল টাকা বন্ধ, সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনা, কালো টাকা নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে ইসিকে তৎপর হতে হবে। সরকার ও ইসির দৃশ্যমান নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। মাঠ প্রশাসন, বেসামরিক প্রশাসন দলীয় মুক্ত করতে হবে, সরকারকে এ ধরনের উদ্যোগ নিতে বলতে হবে ইসিকে।’

সাবেক এ কর্মকর্তা জানান, ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সচিব থেকে ওসি পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। যাতে মানুষের মধ্যে নিরপেক্ষতা ধারণা জন্মে। এবারও কিছু সংখ্যক কর্মকর্তাকে যেন বদলি করা হয়।’

ইসির সাবেক যুগ্মসচিব খন্দকার মিজানুর রহমান জানান, ‘৩৩ বছরের চাকরিকালে ১১টি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ইসির জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল, ভিন্ন পরিস্থিতিতে আসায় এবার সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমান ইসি আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা করছেন। পোস্টাল ব্যালট প্রবাসীদের জন্য কাযকরী করার জন্য প্রথমবার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন, সফল হবেন আশা করি। এটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে।’

সাবেক ইসি কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান তালুকদার জানান, ‘ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দিতে হবে। সেক্ষেত্রে ইসির সরাসরি নিয়ন্ত্রণসহ সব কাজ সুচারুভাবে করতে পারবেন।’

তিনি জানান, ‘নির্বাচন কমিশন, রিটার্নিং অফিসার ও প্রিজাইডিং অফিসার ভোটের প্রধান দায়িত্বে; আর বেসামরিক প্রশাসন সহায়তা করে। ইসির দক্ষ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিলে ভালোভাবে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব।’

ইসির সাবেক উপসচিব মিহির সারওয়ার মোর্শেদ জানান, ২০০৭ সালে পোস্টাল ব্যালটের জন্য কারাগারের ৮৭ হাজার ভোটারের তথ্য সংগ্রহের পরও এগোয়নি। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের সহায়তা না করলে বেশ জটিলতায় পড়তে হবে। ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন করতে হয়েছে। ২০০৬-এর ২২ জানুয়ারির বাতিল নির্বাচনে এমন পরিস্থিতি হয়েছিল, তারা কাজ করবে না।’

পোস্টাল ব্যালটের ভোট নিয়ে হার-জিতের পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘পোস্টাল ব্যালটের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আগামী নির্বাচনে এ নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।’

ইসি কর্মকর্তাদের তৎপরতার কথা তুলে ধরে সাবেক এ কর্মকর্তা জানান, ‘১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে তফসিল চারবার পরিবর্তন হয়েছে। ২০১৪ সালে একবারও পরিবর্তন করা হয়নি। আগামীতেও দলের কথা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।’ তিনি জানান, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে ২০০৮ সালে ইসলামী ব্যাংক, সোশাল ইসলামী ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক কর্মকর্তাদের বাদ দেওয়া হয়েছিল। এবারও কর্মকর্তা নিয়োগে সতর্ক থাকতে হবে। অঙ্গীভূত আনসারদের বিষয়ে ‘দলীয়’ অভিযোগ থাকায় সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচন করেছি। মাঠ প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন নিয়ম ভঙ্গ করেনি। কারণ আমাদের কোনো প্রভু থাকে না। এবারও আমাদের প্রভু থাকবে না, ইসির ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন হবে।’ নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মিছবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ইসি ভালো কাজ করছে। জনগণ এখনো ইসির উপর আস্থা আনতে পারছে না। গত তিনটা নির্বাচনের কারণে এমন হয়েছে। এ জন্য বর্তমান কমিশনকে আস্থা ফেরাতে কাজ করতে হবে।’