জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের পিআর পদ্ধতি নিয়ে বলেন, পিআর (প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী আর ফিরে আসতে পারবে না এবং ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক সরকার ফ্যাসিস্টও হতে পারবে না। পিআর পদ্ধতিতে কেন্দ্র দখল বা টাকা দিয়ে ভোট কেনা যাবে না বলে অনেকে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন চান না। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর দেশের জনগণ সংস্কার চেয়েছে। আমরা সংস্কার চায়, সংস্কারের পরেই নির্বাচনের পক্ষে দেশের জনগণ। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল মনে করে, সংস্কার ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন সবার জন্যই কল্যাণকর। কিন্তু যারা পিআর চান না, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। এদিকে গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্টজনেরা নতুন করে পিআর (প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছেন। জামায়াত থেকে শুরু করে ইসলামী আন্দোলন, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ও শিক্ষাবিদদের একাংশ মনে করছেন, প্রচলিত ব্যবস্থা দেশে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ। তাদের মতে, পিআর পদ্ধতি নিলে সব দলের অংশগ্রহণ সহজ হবে এবং জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠন সম্ভব হবে। তবে কেউ কেউ বলেছেন, জনগণ এখনো এ পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত নয় এবং প্রশাসনিক প্রস্তুতিরও ঘাটতি রয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর সিরডাপ এর এটিএম শামসুল হক মিলনায়তনে সেন্টার ফর এডভান্সড স্টাডিজ এন্ড থটস’-কাস্ট আয়োজিত ‘বাংলাদেশে নির্বাচন পদ্ধতি: পর্যালোচনা ও সুপারিশ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এইসব কথা বলেন। গোলটেবিল বৈঠকে মূল উপস্থাপন করেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির এসবিই ফ্যাকাল্টির ডিন ড. একেএম ওয়ারেসুল করিম। সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ অ্যান্ড থটসের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুর রবের সভাপতিত্বে ও পরিচালনায় গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন, প্রফেসর ড. আব্দুল লতিফ মাসুম, প্রফেসর ড. পেয়ার আহমেদ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. যুবাইর মুহাম্মদ এহসানুল হক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের ড. শামিমা তাসনীম, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব গভর্ণেন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের সহযোগী অধ্যাপক ড. জুবায়ের, প্রফেসর ড. কাজী মোঃ বরকত আলী, তুরস্কের আতাতুর্ক ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ড. মুমিন, কর্নেল (অব.) আশরাফ আল দীন, গবেষক ও কলামিস্ট জনাব শাহ আবদুল হালিম, লিগ্যাল এইড বাংলাদেশ নির্বাহী সদস্য এডভোকেট সাবিকুন্নাহার মুন্নী, বাদশা ফয়সাল ইনস্টিটিউট অধ্যক্ষ লে. কর্ণেল ড. একেএম মাকসুদুল হক, বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ড. ফয়জুল হক, চ্যারিটি প্লাটফর্ম নির্বাহী পরিচালক খোন্দকার জাকারিয়া আহমদ, ইমপেক্ট ইনিশিয়েটিভ চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার এনায়েত হোসাইন জাকারিয়া, সাওয়াব এনজিও নির্বাহী কর্মকর্তা রাশেদুজ্জামান প্রমুখ। গোলবৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদ সদস্য জনাব সাইফুল আলম খান, এডভোকেট শিশির মনির, সাংবাদিক মাসুমুর রহমান খলিলী, সহ আরো অনেকেই।
জাতীয় নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি চালু করা প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, পিআর পদ্ধতিতে টাকা দিয়ে ভোট কেনার সুযোগ নেই। সেজন্য মতলব পূরণ হবে না। পিআর পদ্ধতিতে স্বচ্ছ নির্বাচনের বিরোধিতা করা মানে তারা জাতির প্রত্যাশা নিয়ে সচেতন নয়। উচ্চকক্ষ গঠনে পিআর পদ্ধতির পক্ষেই আমাদের অবস্থান।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, বাংলাদেশের জন্য কোন নির্বাচন পদ্ধতি যৌক্তিক? আমি বলবো একটিও না। মানুষ কিন্তু পরিবর্তন চাচ্ছে। আপনার যদি বলেন বাংলাদেশের কোন নির্বাচন ভালো হয়েছে, আমি কিন্তু বলবো একটি নির্বাচনও ভালো হয়নি। অনেকে বলে ১৯৯৬ সালের কথা। কিন্তু আমাদের কোনো নির্বাচনই ভালো হয়নি। আমরা মোড়াল জায়গাতে অনেকটা পিছিয়ে আছি। তিনি আরও বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থায় পিআর পদ্ধতি আমাদের জন্য আপাত দৃষ্টিতে প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ এটা এখনো একসেপ্ট করেনি। এটা মানুষের সামনে সহজভাবে উপস্থাপন করতে হবে, যেন তারা সহজে বুঝতে পারে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন বলেন, পিআর আমরা ২০০৮ সালে ইশতিহারে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন আমাদের একটা মানুষও সাপোর্ট করে নাই। অথচ এখন পিআর নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। অনেককেই দেখছি গত ৫৩ বছর যাবত গণতন্ত্রের জন্য মায়া কান্না করছে। দেশ শুধু সরকার চালায় না, এর জন্য একটি বিরোধী দল লাগে। দেশ পরিচালনার জন্য বুদ্ধিজীবীদের উচিত সঠিক বুদ্ধি দেওয়া।
গোলবৈঠকে পটুয়াখালি প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, এতদিনকার গতানুগতিক নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে যে বের হতে হবে সে ব্যাপারে দেশব্যাপী একটি ঐক্যমত্য তৈরী হলেও, নির্বাচন ব্যবস্থা কিরকম হওয়া উচিত তা নিয়ে এখনো মতভেদ দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, পিআর এর বিরোধিতাকারী বড় একটি দল তাদের বিরোধিতার পক্ষে কোন শক্ত যুক্তি দেখাতে পারে নি। তাই সামনের নির্বাচনে একটি সমঝোতাস্বরূপ নি¤œকক্ষে এফটিপি মেনে নেয়া গেলেও উচ্চকক্ষে অবশ্যই পিআর ব্যবস্থা চালু করতে হবে এবং পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে যাতে পিআর ব্যবস্থার ব্যাপারে দলটিকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের ড. শামিমা তাসনীম বলেন, ২০২৪ সালের আন্দোলনের পর আমাদের ভোটারদের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। গত ১৫ বছর কিন্তু দেশে কোন ভালো নির্বাচন হয়নি। আমাদের যে নির্বাচন ব্যবস্থা সেখানে শুধুমাত্র শামীম ওসমানের মতো মানুষরাই নির্বাচিত হতে পারে। অন্যরা কিন্তু নির্বাচিত হতে পারে না। যদি রাজনীতিবিদদের চরিত্র না পাল্টায় তাহলে আমাদের কোনো কিছুই করার থাকবে না।
তুরস্কের আতাতুর্ক ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ড. মুমিন বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থা ফ্যাসিস্টের আঁতুড়ঘর বলে মনে হয়। বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় পিআর সিস্টেমের জন্য তুরস্কে পিআর সিস্টেমটা মডেল হতে পারে।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব গভর্ণেন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের সহযোগী অধ্যাপক ড. জুবায়ের বলেন, পিআর পদ্ধতি এমন কঠিন কোনো ব্যবস্থা নয় যে তা সংস্কার করা যাবে না। তবে হ্যাঁ এই পদ্ধতিতে তৃতীয় অনেক শক্তি সহজে আসতে পারে, যা ক্ষতির কারণ হতে পারে। কিন্তু আমরা যদি বিশ্বের অন্য দেশ গুলোর দিকে থাকাই তাহলে তুরস্কের যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছে তা ব্যাবহার করতে পারি৷ কারণ, সেখানে বলা হয়েছে কোনো দল যদি ৫ শতাংশের কম ভোট পায় তাহলে সেই দল কোনো আসন পাবে না। আমরা সে সমস্ত পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারি।
লে. কর্নেল (অব.) মাকসুদুল হক বলেন, আমাদের আগে বুঝতে হবে যে ভোট করার জন্য আমাদের পুলিশ এবং প্রশাসন কতটুকু তৈরি আছে। ভোটের সময় ভোটারদের উপর বা কেন্দ্রে অন্যায়ভাবে প্রভাবিত কতটুকু রুখতে পারবে সেটা বড় বিষয়। না হলে কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করলেও কাজ হবে না।
কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত আশরাফ আল দীন বলেন, পিআর আমাদের দেশের নতুন কিন্তু পৃথিবীতে নতুন না। পিআর চাচ্ছি আমরা সুশাসনের জন্য। বাংলাদেশের দুই একটি দল ছাড়া বাকিরা কিন্তু পিআর চাচ্ছে। পিআরের কিন্তু নানা ভাগ রয়েছে। পিআর এর জন্য জনগণকে প্রস্তুত করতে হবে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় ও অর্থনীতি বিভাগের ডিন প্রফেসর ড. এ কে এম ওয়ারেসুল করিম একটি রিসার্চ পেপার উপস্থাপন করে দেখান, ফ্যাসিবাদ রোধে এফপিটিপি কার্যকর নয়। এক্ষেত্রে তিনি ভারতে বিজেপির উত্থান এবং বাংলাদেশে সাবেক হাসিনা সরকারের উদাহরণ দেখান। তাছাটা এফপিটিপি নির্বাচনে যেসব ভোট হারিয়ে যায় সেগুলো যথাযথ মূল্যায়নের জন্যও পিআর ব্যবস্থা প্রয়োজন। তবে তিনি পিওর পিআর ব্যবস্থার প্রস্তাবনা না করে মিক্সড প্রপোর্শনাল সিস্টেমের প্রস্তাবনা করেন যেখানে সংসদের অর্ধেক আসনে পিআর এবং বাকি অর্ধেক আসনে এফপিটিপি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে।
দুদক সংস্কার কমিশনে বিপ্লবী ছাত্রদের প্রতিনিধি ড. মুনিম মোবাশ্বির বলেন, রাষ্ট্রের সংস্কারের জন্যই জুলাই বিপ্লব হয়েছে অথচ দেশের একটি বড় দল নির্বাচন ও সংস্কারকে মুখোমুখি করে দিয়েছে। পরাজিত শক্তি আওয়ামী লিগ যেমন এতবছর ৭১ এর চেতনা ব্যবসা করেছে, ২৪-এর বিপ্লবকে কেন্দ্র করেও কাউকে ব্যবসা করতে দেয়া যাবে না। কাউকে মাস্টারমাইন্ড বলে ফোকাস করা যাবে না।