রাজধানী ঢাকার দেখভালসহ উন্নয়ন করার জন্য গড়ে তোলা হয়েছিল রাজধানী উন্নয়ন কতৃপক্ষ-রাজউক। রাজধানীবাসীকে সেবা প্রদানের দায়িত্বে এই সংস্থাটি কাজ করছে বিগত ৭০ বছর ধরে। অথচ, তারই সক্ষমতার ঘাটতি পদে পদে। যুগের পর যুগ সক্ষমতা ছাড়াই সংস্থাটি। যে কোন কাজে একবার এগিয়েছে তো, চারবার পিছিয়েছে। প্রয়োজনের তাগিদে কাজের পরিধি বেড়েছে, বাড়েনি কাজ শেষের সক্ষমতা। আর এভাবেই সেবা দিচ্ছে সংস্থাটি। যেটি জন্মের পর থেকেই নানা ভাবে ধুঁকছে।
রাজউক গঠনের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখে গেছে, ১৯৫৩ সালে প্রণীত দি টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৩ আইনের আওতায় ১৯৫৬ সালে ঢাকা এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোর উন্নয়ন ও পরিবর্ধনের বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে সর্ব প্রথম ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) প্রতিষ্ঠিত হয়। ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে পরিচালিত তৎকালীন ডিআইটি পরবর্তীকালে ১৯৮৭ সালে আইন সংশোধনের মাধ্যমে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউক হিসেবে পরিবর্তিত হয়। এরপর ১৯৮৭ সালে রাজউকের অধিক্ষেত্র সাভার, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও অন্যান্য এলাকায় বিস্তৃত হয়।
বর্তমানে পরিকল্পিত আবাসন উন্নয়নে রাজউকে একজন চেয়ারম্যান এবং পাঁচ সদস্যের পর্ষদের পরিচালনায় রাজধানী ও এর আশপাশের রাজউক অধিভুক্ত শহরাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকার পরিকল্পিত উন্নয়ন ও নগর ব্যবস্থাপনার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এতদিন রাজউক গাজীপুর, সাভার, কেরানীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ এলাকার উন্নয়ন পরিকল্পনা দিলেও ২০২০ সালের শেষ দিক থেকে গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব পরিকল্পনায় চলছে। রাজউক অধিক্ষেত্র এলাকা দক্ষিণে ধলেশ্বরী জোড়া ব্রিজ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। নতুন করে পূর্বাচল শহরও রাজউকের আওতায় এসেছে।
রাজধানী ও এর আশ পাশের বড় কয়েকটি এলাকা রাজউকের অধিক্ষেত্র হলেও নিজদের সক্ষমতা গড়ে তুলতে পারেনি সংস্থাটি। প্রয়োজনের তাগিদে রাজউকের এলাকা বাড়ছে, নতুন নতুন এলাকা যুক্ত করার পরিকল্পনা হচ্ছে। কিন্তু এসব এলাকার উন্নয়নসহ দেখভাল করা, নগরবাসীকে সেবা দেয়ার মতো জনবল নেই সংস্থাটির। এটিই এখন সকল স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বাঁধা।
রাজউকের প্রধান কার্যালয়টি রাজধানীর দিলকুশা এলাকায়। বাহির থেকে বহুতল বিশিষ্ট এই ভবনটি অন্যতম স্থাপনা হিসেবে দেখা গেলেও এর ভেতরের চিত্র কেউ দেখেনা। এর ভেতরে নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ বছরের পর বছর শোনা গেলেও এর বিপরীত চিত্রটি অদেখা। প্রায় দু’হাজার জনবল নিয়ে চলার কথা থাকলেও এখানে কাজ করছে ১২ শতাধিক। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে লোক নেই, চলছে চলতি দায়িত্ব-অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে। একজনের ওপর রয়েছে কয়েকটি দায়িত্ব। শূন্যতা পূরণের উদ্যোগ শুধু মুখে মুখে, কাগজে কলমে। বাস্তবে নেই।
জানা গেছে, রাজউকের বর্তমান যে জনবল রয়েছে, তাদেরই বসার জন্য জায়গা নেই, নেই প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রও। তার সাথে নেই সেবা গ্রহিতাদের জন্য বসার বা অপেক্ষার প্রয়োজনীয় স্থানও। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নেই ওয়াসরুম, সেবা গ্রহীতাদের জন্য নেই বাথরুম। যে কয়টা আছে তা ব্যবহার অনুপযোগী। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যে কয়টা বাথরুম-ওয়াশরুম রয়েছে, সেগুলোর অবস্থাও বর্ণনাতীত। পানি থাকেনা। নামাজের ওযু করার জন্য পানি পাওয়া যায় না, দুগর্ন্ধযুক্ত পানি মুখে নিলে বমি আসার উপক্রম ঘটে। যে কারণে কয়েকটি শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদের ব্যবস্থাপনায় চাঁদা তুলে বাহির থেকে পানি এনে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সারছেন। এতে করে নাগরিক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রটা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মন-মর্জির ওপর নির্ভর করছে, সেবার ব্যঘাত ঘটছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজউক পরিচালিত নকশাবহির্ভূত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানও স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয়না নানা কারণে। অভিযানে যেতে অনেকেরই অনিহা। তার কারণ হিসেবে জানা গেছে, প্রতিটা অভিযানে যেতে লাগে জনবল, পুলিশ, পরিবহনসহ নানা যন্ত্রপাতি। লেবার নিতে হয় পারিশ্রামিক দিয়ে। পুলিশ আনতে নিতে লাগে পরিবহন। নানা যন্ত্রপাতি ভাড়া বাবদ দিতে হয় মোটা অংকের টাকা। অভিযানে যাওয়া সকলের জন্য লাগে ভাড়ায় নেয়া পরিবহন। আপ্যায়নও লাগে। সবমিলে একটি অভিযান চালাতে রাজউকের ব্যয় হয় কমপক্ষে এক লাখ টাকা। অথচ, অভিযান বাবদ রাজউকের বরাদ্দ ৬০ হাজার টাকা। বাকী ৪০ হাজার টাকা পাওয়া যায়না। ‘অন্যের পকেট কাটতে হয়’, এমন অবস্থার কথাই সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে শোনা।
সূত্র জানায়, সরকার থেকে প্রতি বছরই বাজেট পেয়ে থাকে রাজউক। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে সেই বাজেটের ছাড় মেলেনা। তাই বাজেট থাকা সত্ত্বেও রাজউক প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করতে পারে না। এই না পারার কারণেই রাজউকের অবস্থা ‘নেই আর নেই’।
সামগ্রিক বিষয়ে জানতে গত দু’দিন (সোম ও মঙ্গলবার) রাজউকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম এর মুঠোফোনে কয়েক দফায় কল করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।