আজ ৯ জুলাই বুধবার। ২০২৪ সালের ৯ তারিখ ছিল মঙ্গলবার। দিন যতই অতিবাহিত হতে থাকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন ততই কঠোর করতে থাকে। কর্মসূচি পালন করাও কঠিন হতে থাকে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর তৎপরতা বাড়তে থাকে বহুগুণে। যেহেতু সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরকার টিকিয়ে রাখার ঠিকাদারি নিয়েছিল একইসাথে সুবিধাভোগী ছিল; তাই আন্দোলন ফুৎকার দিয়ে নিভিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিল। বিশেষ করে পুলিশ প্রধান, সেনা প্রধান, ডিবি হারুণ, বিপ্লব সরকার এরকম উচ্চ পদস্ত কর্মকর্তারা হাসিনার স্বৈরাচারকে হালাল করে দিয়েছিল। দমন পীড়নের মাধ্যমে হাসিনার স্বৈরাচারী সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার ইজারা নিয়েছিল। তারা তাদের বাহিনী দিয়ে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সাথে জড়িতদের নস্যাৎ করে দিতে চেয়েছিল। প্রথমে তারা নেতাদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। তাতে কাজ না হওয়ায় তারা নির্যাতনের পথ বেছে নেয়। অন্য দিকে কঠিনেরে ভালবেসে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার শপথ নেয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র শিবির এবং কেন্দ্রীয় ছাত্র শিবিরের সমর্থন থাকায় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কোন বেগ পেতে হয়নি।
তৎকালীন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিবির নেতা সিবগাতুল্লাহ সিবগা তার বয়ানে বলেন, মিছিল-মিটিংসহ বিভিন্ন কর্মকা-ে অংশ নিয়েছি। সেসময় আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল। জনমত গঠন, আমাদের জনশক্তিকে আন্দোলনে যুক্ত করা এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। যেহেতু ওই সময় আন্দোলনে অরাজনৈতিক গোষ্ঠী সামনের সারিতে ছিল, তাই সাংগঠনিক বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবিরই সর্বাত্মক সহায়তা করেছে।
কোটা বাতিলের পর আমরা অভ্যন্তরীণ বৈঠক করেছি। আলোচনা করেছি যে, আন্দোলনে আমরা কীভাবে অংশ নেব। আমাদের বড় দাবি ছিল চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ, কোটা নয়। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যে করেই হোক কোটাব্যবস্থা যাতে পুনর্বহাল না হয়, সেটি প্রতিরোধ করতে হবে।
তিনি বলেন, প্রশাসনের উচ্চপদস্থরা মূলত সরকারের সুবিধাভোগী ছিলেন। তারা কোনোভাবেই চায়নি আন্দোলন সফল হোক। কর্মসূচিগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এক প্রকার অসহযোগিতা ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়িও ছিল। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কারণে তারা বড় কোনো দমনমূলক পদক্ষেপ চাপিয়ে দিতে পারেনি। প্রথমে হল প্রভোস্ট এবং পরে ছাত্রলীগের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করা হয়। শিক্ষার্থীরা যেন হল থেকে বের হয়ে আন্দোলনে অংশ নিতে না পারে, সেজন্য তাদের চিহ্নিত করা এবং দেশদ্রোহী আখ্যা দেয়া হয়েছিল।
আগের দিন ৮ তারিখ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ঘোষণা করেন ৯ জুলাই মঙ্গলবার ব্লকেড কর্মসূচি থাকবে না। ছাত্র ধর্মঘট এবং ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি পালন করা হবে। আমরা সারাদেশে সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচির পরিকল্পনা করছি। এজন্য মঙ্গলবার সারাদেশে অনলআইন ও অফলাইনে গণসংযোগ করব। বুধবার সারাদেশে সর্বাত্মক ব্লকেড কর্মসূচি পালন করা হবে।
দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের সমর্থন বৃদ্ধি পাওয়ায় জুলাই মাসেই কোটা সংস্কার আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের প্রতিটি কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী। কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে লাগাতার কর্মসূচি চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগের সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজেরাই কোটা বিরোধী পোস্টার প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার ছাপিয়ে আন্দোলনে শরিক হয়।
ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কাজে লাগিয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, আবাসিক হল ও বিভাগ ভিত্তিক নেটওয়ার্ক তৈরি করে ছাত্ররা সংগঠিত হতে থাকে। ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে ক্যাম্পাসে অবস্থিত আবাসিক হলগুলোতে সমন্বয়কারীরা গণসংযোগ করেন। ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আবাসিক হলগুলোতে আন্দোলনের সমর্থনে প্রচারপত্র বিলি করতেও দেখা গেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে প্রথম থেকেই সোচ্চার ছিল। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় করে ঢাকা আরিচা মহাসড়কে ধারাবাহিক অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করে তারা।
ততদিন ছাত্রছাত্রীদের সংগঠিত করতে গঠিত হয় আহ্বাবায়ক কমিটি। আন্দোলনের প্রচারে নানা কৌশল তারা কাজে লাগায়। ক্যাম্পাসে মাইকিং, হলে হলে গণসংযোগ করা হয়। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে খুলনা থেকে চট্টগ্রামে, বরিশাল থেকে সিলেট, রাজশাহী-কুমিল্লাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে।
২০২৪ সালের ৯ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালনের পর সমন্বয়ক টিমকে ভাগ করে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাতে ভালো মতো সমন্বয় করা যায়। তৎকালীন সমন্বয়কের শীর্ষ পর্যায়ে থাকা হাসনাত আব্দুল্লাহ জানান, সেই দায়িত্বের অংশ হিসেবে আমি কুমিল্লায় যাই। ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে গিয়ে ছাত্রদের সাথে কথা বলি। সেখানে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যেখানে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হয়েছে সেই স্থানগুলো পরিদর্শন করি এবং ছাত্রদের নির্দেশনা দেই। সেদিন সমন্বয়করা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। সমন্বয়করা ছাত্রলীগ ও পুলিশের তা-বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল।
হাসনাত আব্দুল্লাহ আরও বলেন, ৯ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির আগে সর্বপ্রথম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন। আমরা তখন শাহবাগে ছিলাম। শাহবাগে আন্দোলন চলাকালীন আমাদের ডেকে নিয়ে যায়। আমাদের সাথে নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ছিলো। তখন টিএসসিতে ওই কর্মকর্তা আমাদের সাথে কথা বলেন। শাহবাগ থানার পুলিশসহ অন্যান্য জোনের পুলিশও ছিলো সেখানে। তিনি জিজ্ঞেস করেন, আমাদের মোটিভ কী? আমরা বার বার বলেছি, রাষ্ট্রের মধ্যে যে বৈষম্য আছে তা নিরসনের জন্য আমরা আন্দোলন করছি। পুলিশ আমাদের ওপর প্রেশার দিতে থাকে আমরা যেন আন্দোলন তুলে নিই। কিন্তু আমরা বলেছি, শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেট ছাড়া আমাদের পক্ষে আন্দোলন বন্ধ করা সম্ভব নয়।
৯ জুলাই হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে দুই শিক্ষার্থী আবেদন করেন। আন্দোলনের অংশ হিসাবে শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীরা চার ঘণ্টা পর অবরোধ তুলে নেন। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে পরদিন সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।
সমন্বয়ক সিয়াম তার বয়ানে বলেন, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ আমাদের কর্মসূচির অন্যতম অংশ ছিল। এই মহাসড়ক ঢাকা ও উত্তরবঙ্গের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হওয়ায় এটি অবরোধ করলে কেন্দ্রীয়ভাবে সেটার প্রভাব পড়তো। তাই আমরা ঝুঁকি নিয়ে হলেও এটা করতাম। এতে রাস্তায় চলাচলকারী সাধারণ মানুষের কিছুটা দুর্ভোগ হতো, তবে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রায় সকল মানুষই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তারা স্বৈরাচারের পতনকে ত্বরান্বিত করতে কিছুটা দুর্ভোগ হাসিমুখে মেনে নিতো। অবশ্য আমরা সবসময় একটা ইমার্জেন্সি লেন রাখতাম। রোগীর অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি চলাচলের জন্য ইমার্জেন্সি লেন ব্যবহার করাতাম।
অনেক আশা প্রত্যাশা নিয়ে আমরা স্বৈরাচার মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে লড়াই করেছিলাম। আন্দোলন চলাকালীন আন্দোলনে যুক্ত সকলেই নানাভাবে হুমকির মুখে পড়েছিল। অনেকের গ্রামের বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালিয়েছিল। আমাদের ক্যাম্পাসের অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে ডিবি পুলিশ গুম করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমাকেও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা নজরদারিতে রেখেছিল। আমার শেরপুরের বাসায় পুলিশ গিয়েছিল। স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকজন আমার পরিবারকে নানাভাবে হেয় করতো।
আন্দোলন যেহেতু দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিলো তখন এটা আর ক্যাম্পাসে সীমাবদ্ধ ছিল না। সাভার এলাকায় আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের সন্ত্রাসীরা হামলা করতো। তখন আমরা ক্যাম্পাসে সামনে গিয়ে সেটা প্রতিরোধ করতাম। এরই মধ্যে একদিন সাভারের এমপি সাইফুল ইসলামের সন্ত্রাসী বাহিনীর সাথে ডেইরী গেইটে সরাসরি সংঘর্ষ হয়েছিলো। তারা সাভার এলাকায় আন্দোলনকারীদের আক্রমণ করে ফিরে আসার সময় আমরা তাদের প্রতিরোধ করি। সেদিন অনেকে হতাহত হয়েছিলো। তবে আমরা তাদেরকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
আরেক সম্বয়ক আরিফ সোহেল তার বয়ানে বলেন, জুলাই আন্দোলনে পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সকল নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা ছিলো খুবই ন্যক্কারজনক। ছাত্রলীগের কাছ থেকে আমরা যেটা আশা করেছিলাম সেটাই হয়েছিলো। কারণ এর আগেও সকল জনবান্ধব ও শিক্ষার্থীবান্ধব আন্দোলনে তারা হামলা করেছিলো। শিক্ষার্থীদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছিল। নিরাপত্তা প্রদানের নামে ক্যাম্পাসে পুলিশ আনা হয়েছিলো। কিন্তু আমরা কল্পনাও করিনি যে পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনী এত নগ্নভাবে আমাদের ওপর হামলা করবে। তারা হানাদার বাহিনীর মতো আমাদের ওপর আক্রমণ করছিলো। তাদের বিরুদ্ধেও আমাদের লড়াই করতে হয়েছে। তারা একটা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী। অথচ তারা সেই জায়গা থেকে সরে গিয়ে একটা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের বাহিনী হিসেবে কাজ করেছিলো।
আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর বাধা অত্যাচার নির্যাতনের মধ্যেও শিক্ষার্থীরা দমে যায়নি। তারা চুপিসারে গ্রাফিতি এঁকে প্রতিবাদ করে। আন্দোলনের সময়ে আঁকা গ্রাফিতি, পোস্টারে ভরে থাকা দেয়াল, মেট্রোরেলের পিলার, সড়ক বিভাজক, ঢাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রধান সড়কের দেয়াল পাল্টে যেতে থাকে। বিভিন্ন রঙে রঙিন হতে থাকে। ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সহায়তায় প্রতিবাদী তরুণরা যা যা চায় এবং মনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় দেয়ালে দেয়ালে রং-তুলি দিয়ে। শাহবাগ, টিএসসি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, মোহাম্মদপুর, বেইলি রোড, খিলগাঁও, মালিবাগ, মিন্টো রোড, মিরপুর, সেগুনবাগিচা, রামপুরাসহ পুরো ঢাকায় দেয়ালচিত্র এঁকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের সময়ের বিভিন্ন স্মৃতি তুলে ধরে। সেই সঙ্গে দেশের প্রায় প্রতিটি শহরে তা ছড়িয়ে যায়।