পতিত হাসিনা সরকারের ছয়টি সংস্থা ১৬ বছর ধরে গুমের সঙ্গে জড়িত ছিল। এরমধ্যে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে ২৩ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম বেরিয়ে এসেছে। এরা র‌্যাব ও ডিজিএফআই এর সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। গুম থেকে ফিরে আসা দুই ভুক্তভোগীর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তাদের নাম পেয়েছে তদন্ত কমিশন। রিপোর্টে এসেছে ছয়টি সংস্থা তিন ধাপে আওয়ামী লীগের সরকারের সময় এসব গুম করেছে।

এই ২৩ জন হলেন র‌্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদ, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, খুরশীদ হোসেন ও হারুন অর রশীদ, র‌্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক আনোয়ার লতিফ, তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, কামরুল হাসান, আব্দুল্লাহ আল মোমেন, জাহাঙ্গীর আলম, কে এম আজাদ ও মাহবুব আলম, র‌্যাবের সাবেক গোয়েন্দা উইংয়ের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ, সারোয়ার বিন কাশেম, মশিউর রহমান জুয়েল, মাহবুব আলম, খাইরুল ইসলাম ও সাইফুল ইসলাম সুমন, ডিজিএফআইয়ের সাবেক ৫ ডিজি আকবর হোসেন, সাইফুল আলম, আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী, সাবেক পরিচালক তৌহিদ-উল-ইসলাম, সাইফুল আবেদীন ও হামিদুল হক।

তদন্তকমিশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ফাঁসি দেয়ার কয়েক দিন আগে মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাশম আরমানকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে গুম করা হয়। প্রায় ৮ বছর পর বন্দী থেকে মুক্ত হন তিনি। তাকে যে স্থানে বন্দী করে রাখা হয় সেই স্থান পরিদর্শন করেছেন কমিশন। আরমানের এই ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে গুম সংক্রান্ত তদন্তকমিশন মনে করেছিল তাকে হয়তো আয়না ঘরে রাখা হয়েছে, কিন্তু তার সাক্ষ্য অনুযায়ী প্রমাণ মিলে তাকে আয়নাঘরে নয় রাখা হয়েছিল র‌্যাবের একটি গোপন সেলে। যার কোড নাম ছিল ‘হাসপাতাল’ বা ‘ক্লিনিক’। আরমানের গুমের সাথে জড়িত যারা জড়িত ছিল র‌্যাবের এমন কয়েকজন কর্মকর্তার নাম এসেছে তদন্ত রিপোর্টে। কমিশনের একজন সদস্য একটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে বলেন, এক বাহিনী তুলে এনেছে আরেক বাহিনী হয়তো অন্য বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছে। একটি ঘটনায় কয়েকটি বাহিনী জড়িত ছিল। বিশেষ করে র‌্যাব এবং ডিজিএফআইয়ের ইন্টেলিজেন্স উইং গুলো ২০০৯ সালে থেকে শুরু করে ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত এ কাজ করেছে।

কমিশনের আরেকটি ঘটনার বিবরন প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে তা হলো সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আবদুল্লাহিল আমান আযমীর গুমের ঘটনা নিয়ে। রিপোর্ট বলা হয়েছে আবদুল্লাহিল আমান আযমী যতদিন গুম ছিলেন সে সময় ডিজিএফআইয়ের দায়িত্বে ছিলেন একজন পরিচালক যাদের সবাইকে ৫ আগস্টের পর চাকরি থেকে অবসর দেওয়া হয়। অপর একটি সূত্র জানায়, গোয়েন্দা সংস্থাটির জয়েন্ট ইন্টারগেশন সেল বা জেআইসি’র কোড নাম ছিল ‘আয়না’ ঘর। ডিজিএফআইয়ের এই সেলের আগে নাম ছিল ব্ল্যাক হোল। তারপরে ২০০৯ সালের কোন এক সময় এর নাম দেওয়া হয় ‘আয়না ঘর’। আয়না ঘর তাদেরই দেওয়া নাম। ওই সূত্রটি আরও জানায়, গুমের সাথে ডিজিএফআই জড়িত ছিল আগে তাদের জানা ছিল না। এ বিষয়ে প্রোফাইল তৈরি করে তা সকল ও কর্মকর্তাদের সরবরাহ করা হয়। পরে র‌্যাবের একজন অফিসার সর্বপ্রথম তাদেরকে বলেন যে, উনি এই আয়না ঘর চিনেন। এই কমিশনের রিপোর্টে শুধুমাত্র এ দুটি ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছে। তবে ইলিয়াস আলী, চৌধুরীর আলম, বা সাজেদুল সুমনের মত বড় ঘটনার আদ্যপ্রান্ত এখনো তদন্ত হচ্ছে। কমিশনের শেষ রিপোর্টে ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত গুমের সাথে জড়িত ও দায়ী আরো কর্মকর্তার নাম আসবে বলে জানিয়েছেন কমিশন সদস্যরা।

গুমের শিকার ব্যক্তিদের সম্ভাব্য চার ধরনের পরিণতি হয়েছিল বলে জানিয়েছে গুম-সংক্রান্ত তদন্তকমিশন। কমিশনের প্রধান বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কমিশনে জমা অভিযোগগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, গুমের শিকার ব্যক্তিদের সম্ভাব্য চার ধরনের পরিণতি হয়েছিল। সেগুলো হলো ভুক্তভোগীকে হত্যা। বিচারের আগেই ভুক্তভোগীকে গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করে সাধারণত জঙ্গি তকমা দিয়ে বিচারাধীন বা নতুন ফৌজদারি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো। ভুক্তভোগীকে সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করা। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে মামলা না দিয়ে ভুক্তভোগীকে ছেড়ে দেওয়া।

কমিশন গত ৪ জুন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয়। সংবাদ সম্মেলনে কমিশনপ্রধান বলেন, ‘প্রতিবেদনে আমরা তুলে ধরেছি, বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত দমননীতির অংশ হিসেবে গুমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও বহু অপরাধী এবং তাদের শুভাকাক্সক্ষীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করায় অনেক জোরালো প্রমাণ ও নিদর্শন ধ্বংস করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগিতা, সাক্ষীদের ভয়ভীতিসহ নানা আতঙ্কজনক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এসব ব্যক্তির নাম প্রকাশ করলে ভুক্তভোগীদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে বলে প্রকাশ করা হচ্ছে না।

তবে সেনাবাহিনী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গুমের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও, বিভিন্ন বাহিনীতে ডেপুটেশনে থাকা এই বাহিনীর সদস্যরা জড়িত ছিলেন। তিনি বলেন, এটি ঠিক গুমের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনী জড়িত নয়। কিন্তু ডিজিএফআই, এনএসআই ও র‌্যাবের বিশেষ করে কমান্ডিং অফিসাররা কিন্তু সেনাবাহিনীর। গুমের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। বেসিক্যালি তারা তো আর্মড ফোর্সেসের অফিসার। তারা আর্মির হতে পারে, নেভির হতে পারে, এয়ারফোর্সেরও হতে পারে। এ বিষয়ে কমিশনের সদস্য মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, তারা (সেনাবাহিনী) জানত না, এটি বলার সুযোগ নেই। তাদের সাবেক এক সেনাপ্রধান পাবলিক স্টেটমেন্ট দিয়েছেন-দুইজন সেনা সদস্য এ ধরনের কাজে যুক্ত হতে চান না বলে তার কাছে আশ্রয় চেয়েছেন। তারা অফিসিয়ালি ইনভলভ ছিল না। কিন্তু জানত না, এটি বলার সুযোগ নেই।