খুলনা জেলার দাকোপ, পাইকগাছা ও কয়রাসহ উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধে ভাঙন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। নদ-নদীতে পানির চাপ আরও বাড়লে নড়বড়ে বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অতিদ্রুত ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো মেরামত না করলে যে কোনো সময়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হতে পারে। আর এতে চলতি আমন মওসুমে ধানের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হবে। সম্প্রতি বেড়িবাঁধ ভেঙে দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের বটবুনিয়ায় ঢাকী নদীর পানি হু-হু করে ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। পরবর্তীতে তা গড়িয়ে চলে যায় ফসলি জমিতে। এতে হাজার হাজার বিঘা আমন ধানের ক্ষেত তলিয়ে যায়।

খুলনা জেলায় প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধের মধ্যে ৩০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এ ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলো ভেঙে যেতে পারে। দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা না থাকায় এ সব বাঁধ নিয়ে চিন্তিত উপকূলের মানুষ। তারা জানান, প্রতিবছরই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা। ভাসিয়ে নেয় হাজারো মানুষের বসতি, কাড়ে জীবন-জীবিকা। লবণাক্ত পানিতে নিমগ্ন থাকার কারণে এলাকার ভৌত অবকাঠামো তথা রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়। নষ্ট হয় ঘরবাড়ি ফসলি জমির ফসল। মরে যায় গাছপালা। অনেকে হয় গৃহহীন। এ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র পথ প্রযুক্তি নির্ভর টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ। কিন্তু টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ তো দূরের কথা জোড়াতালির মেরামতেও চলে হরিলুট। এমন অভিযোগ খুলনাঞ্চলের উপকূলের বাসিন্দাদের।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড় থেকে শুরু করে ২০২০ সালের আম্পান পর্যন্ত একের পর এক দুর্যোগে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে। আইলা ও আম্পানে শুধু খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চলেই ৫০ হাজার পরিবার বাস্তচ্যুত হয়, হারায় ২৫ হাজার হেক্টর কৃষিজমি, যা লবণাক্ত হয়ে এখন চাষযোগ্য নয়। সাম্প্রতিককালেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ২০২৫ সালের ৭ অক্টোবর দাকোপের বটবুনিয়ায় রাতের আঁধারে আবারও ভেঙেছে বাঁধ। জোয়ারের পানিতে ডুবে গেছে ঘের ও ফসল। স্থানীয়রা বলছেন, বাঁধ আছে, কিন্তু টেকে না।

খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার অন্তর্গত বেদকাশী, শাকবাড়িয়া, গাবুরা এই নামগুলো এখন নদীভাঙনের প্রতিশব্দ। ১৯৮৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত তিনবার নদীভাঙনে বাড়ি হারিয়েছেন ঠাকুরপদ বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘একসময় বাড়ি ছিল এত বড়, এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যেতে দৌড়াতে হতো। এখন সবই নদীতে।’ বর্তমানে বাঁধটিও ঝুঁকিপূর্ণ। টেকসই বেড়িবাঁধ না হলে যেকোনো রাতে পুরো এলাকা পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। নিজে স্ট্রোকের রোগী, স্ত্রী ক্যান্সারে আক্রান্ত, তারপরও জীবনযুদ্ধে থেমে নেই তারা।

শাকবাড়িয়ার কল্যাণীও প্রতিদিন এই লড়াইয়ের সৈনিক। ‘যখন মাছ পাই না, তখন অন্যের জমিতে কাজ করি’ , বললেন তিনি। দক্ষিণ বেদকাশীর রাজিয়া গাজি তার ভেসে আসা জীবন নিয়ে বলেন, নদীর সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে শিখেছি, কিন্তু এখন নদীই ঘরে ঢুকে পড়ে।

কয়রার দেয়াড়া গ্রামের শরিফুল ইসলাম বলেন, দশহালিয়া, হরিণখোলা, তেঁতুলতলা, কাট কাটা বাঁধ নড়বড়ে অবস্থায়। দুর্যোগ কিংবা বর্ষায় অধিক জোয়ারের সময় আতঙ্কে থাকেন কয়রাবাসী।

দক্ষিণ বেদকাশির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. ওসমান গনি খোকন বলেন, ‘এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা যোগাযোগ। এলজিইডির কাজ বন্ধ। এনজিওরা কাজ করছে, কিন্তু চাহিদার তুলনায় কিছুই না।’ তার মতে দুর্যোগ প্রশমনে সরকারি-বেসরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি অন্যান্য সবার সমন্বিত উদ্যোগের কোন বিকল্প নেই।

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, উপকূলীয় জেলা খুলনা দেশের অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দুর্যোগকবলিত অঞ্চল। ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাস হলে যে কয়টা জনপদ ক্ষডুগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, খুলনার কয়রা তার মধ্যে অন্যতম। ভাঙনের পর বেড়িবাঁধ জোড়াতালি দিয়ে যাচ্ছে প্রতিবছর। একেবারে ভালোভাবে মজবুত করলে বারবার প্রকল্প নেওয়া যায় না তাই এই ফন্দি পাউবো আর ঠিকাদার সিন্ডিকেটের।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রকল্পগুলোকে অনেকেই বলছেন আস্থাহীন। দুর্বল বাঁধ, তড়িঘড়ি মেরামত সব মিলিয়ে নদীর প্রবল স্রোতের সামনে দাঁড়ায় না কিছুই। পরিবেশকর্মীরা আশঙ্কা করছেন, এই ধারায় চলতে থাকলে দক্ষিণ বেদকাশী একসময় বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হবে।

পাইকগাছার শান্তা এলাকার শাফায়াত হোসেন বলেন, এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ শান্তা লঞ্চ পাশবর্তী কুমখালী ( খুদখালী) এলাকায়। নদী ভাঙনকবলিত এলাকা। বিগত ১০ বছর যাবত এই এলাকায় ভাঙন রোধে কাজ চলছে। কাজের কোন অগ্রগতি নাই। টেন্ডার হয় কাজ হয়। নদী ভাঙে আবার টেন্ডার হয়। এভাবেই চলছে বিগত ১০ বছর যাবত। ঝুঁকিতে আছে গড়াইখালী ইউনিয়নও। এখান দিয়ে ভাঙলে আশেপাশের পাইকগাছা থানার ও কয়রার কয়েকটা ইউনিয়ন, পাইকগাছার চাঁদখালি, গড়াই খালি, গজালিয়া চরমভাবে বিপর্যস্ত হবে। তিনি আরও বলেন, কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর এবং আমাদি ইউনিয়নের দুটি ইউনিয়ন এখান থেকে ভাঙলে এই ভাঙনের কারণে ফসল রবি শস্য সবই মারা যাবে। বর্তমান আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু কৃষকরা হতাশাগ্রস্ত। পার্শ্ববর্তী সুন্দরবন। সুন্দরবনের হড্ডা এলাকা থেকে শুরু করে খালী বাজার পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তায় জোয়ারের পানি উপচেপড়ে। এই দীর্ঘ রাস্তা এতটা ঝুঁকিপূর্ণ যে মানুষ চলাচলের অনুপযোগী একটা পরিবেশ এখানে সৃষ্টি হয়ে আছে।

শাফায়াত হোসেন বলেন, রাস্তার অনেক অংশ জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকে। এতে রাস্তা ভেঙে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। লোকালয়ে পানি ডুকে যাচ্ছে। স্থানীয় জনগণের দাবি হলো এই ভাঙনরোধ করে তাদের আমন ধান যাতে রক্ষা করা হয়। ভাঙনের হাত থেকে যাতে তারা স্থায়ী রক্ষা পায় সে ব্যবস্থা করা।

দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের বটবুনিয়ার মহেশ্বরী ঢালী বলেন, ২-৩ মাস আগে আমার ঘর নদী ভাঙনে ভেঙে গেছে। পুরোনো ঘর বাড়ি কিছুই নেই। পরে বিলের মধ্যে গিয়ে ঘর করেছি। তাও ঢাকী নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ঘরে জোয়ারের পানি ডুকে গেছে। সব ভিজে গেছে। খাটের ওপর বাচ্চারা বসতে পারছে না জিনিসপত্র রাখার কারণে।

অভিযোগ রয়েছে, নানা সময় বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ মেরামত ও সংস্কার করা হয়। তবে বাঁধের কাজ হয়ে থাকে দায়সারা। বেড়িবাঁধের কাজে অনিয়ম-দুর্নীতিই যেন ‘নিয়মে’ পরিণত হয়েছে। কাজেকর্মে নেই কোনো তদারকি। এ কারণে জোড়াতালি মেরামতের পেছনে শত শত কোটি টাকা সরকার খরচ করলেও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। বরং পকেট ভারী হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী, ঠিকাদার সিন্ডিকেট ও রাজনৈতিক একটি মহলের।

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (খুলনা-২) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, খুলনা জেলায় প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধের মধ্যে ৩০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলার তিন কিলোমিটার।