শফিকুল ইসলাম, গোমস্তাপুর (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) : বাংলার বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে একসময় বর্ষা ও শরৎ মৌসুম এলেই পুকুর-ডোবা, বিল-হাওর, খাল-ঝিলে ভেসে উঠত পানিফলের সবুজ পাতা আর কালো-সোনালি ফল। বাজারে গেলে বাঁশের ডালায় সাজানো পানিফল ছিল কৃষক-জেলে পরিবারগুলোর বাড়তি আয়ের অন্যতম সম্বল। ঘরের শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক পর্যন্ত সবাই অপেক্ষায় থাকত মৌসুমি এই ফলের জন্য। কিন্তু সময় পাল্টেছে, বদলে গেছে গ্রামীণ জলাশয়ের পরিবেশ। সেই পানিফল এখন বিরল, প্রায় বিলুপ্তির পথে।

নানা কারণে হারিয়ে যাচ্ছে পানিফল

১. জলাশয়ের সংখ্যা কমে গেছে

গ্রামীণ খাল-বিল এবং ছোট ছোট পুকুর যেখানে পানিফল জন্মাততার অনেকই ভরাট হয়ে গেছে। কৃষি জমি বাড়াতে জলাশয় দখল ও ভরাট হওয়ায় পানিফলের স্বাভাবিক আবাস দ্রুত হারিয়ে গেছে।

২. দূষণ ও কীটনাশকের প্রভাব

আধুনিক কৃষিকাজে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক বৃষ্টির পানির সাথে খাল-বিলে গিয়ে মিশছে। পানিফল অত্যন্ত সংবেদনশীল উদ্ভিদ; পানি দূষিত হলে এর বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ দূষণই পানিফল কমে যাওয়ার বড় কারণ।

৩. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

মৌসুমি বৃষ্টিপাতের অস্থিরতা, দীর্ঘ শুষ্ক মৌসুম ও হঠাৎ অতিবৃষ্টি এসব কারণে জলাশয়ের পানির স্বাভাবিক গভীরতা থাকে না। পানিফলের জন্ম-বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন স্থির পানি ও নির্দিষ্ট তাপমাত্রা, যা এখন আর বজায় থাকছে না।

৪. অতিরিক্ত আহরণ

একসময় পানিফল সংগ্রহ ছিল নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু বাজারে চাহিদা বাড়ার পর অনিয়ন্ত্রিত আহরণ শুরু হয়। ফলে প্রাকৃতিকভাবে পুনরায় বংশবিস্তার করার সুযোগ হারায় উদ্ভিদটি।

গ্রামের মানুষের স্মৃতিতে পানিফল

বেশ কয়েকজন প্রবীণ কৃষকের মুখেই শোনা যায়“আগে বাড়ির পুকুরেই পানিফল হত; বিক্রি করতাম, খেতাম, বাচ্চাদেরও দিতাম।” পানিফলের সেদ্ধ বা ভাজা স্বাদ অনেকেরই শৈশবের স্মৃতিকে নতুন করে জাগিয়ে দেয়। এটি ছিল সুলভ, পুষ্টিকর এবং স্বাভাবিকভাবেই উৎপন্ন একটি মৌসুমি খাবার। এখন সেসব স্মৃতি যেন ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

অর্থনৈতিক ও পুষ্টিগুণ

পানিফল শুধু মৌসুমি খাবারই নয়, এতে রয়েছে প্রচুর শর্করা, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও খনিজ পদার্থ। কম খরচে বেশি ফলন হওয়ায় যেসব পরিবারের কৃষিজমি নেই, তারা জলাশয় থেকে পানিফল সংগ্রহ করে বাড়তি আয় করতেন। ফলে এটি ছিল একধরনের গ্রামীণ অর্থনীতির সহায়ক ফসল। পানিফল কমে যাওয়ার ফলে সেই আয়ের উৎসও হারাচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী।

ফিরিয়ে আনা কি সম্ভব?

গবেষকদের মতে, সঠিক পরিকল্পনা ও পানি ব্যবস্থাপনা থাকলে পানিফল ফিরিয়ে আনা কঠিন নয়।

জলাশয় দখল ও ভরাট বন্ধ করতে হবে

খাল-বিল নিয়মিতভাবে খনন ও সংরক্ষণ করতে হবে

রাসায়নিক দূষণ কমাতে হবে

স্থানীয়ভাবে পানিফল চাষের উদ্যোগ নিতে হবে

এছাড়া ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ে জলাশয় সংরক্ষণ কার্যক্রম শুরু হলে পানিফল উৎপাদন আবারও বাড়তে পারে। স্থানীয় কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা গেলে খুব অল্প খরচেই পানিফল চাষ করা সম্ভব।

সমাপনী কথা

যে পানিফল একসময় গ্রামীণ জীবনের অংশ ছিল, তা আজ হঠাৎ করে হারিয়ে যেতে বসেছে। শুধু পানিফল নয়, হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের জলজ জীববৈচিত্র্য, গ্রামীণ খাদ্যসংস্কৃতি আর এক বিশাল জীবিকা-ব্যবস্থা। সময় থাকতে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে জলাশয় রক্ষা করতে হবে, প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে। তাহলেই হয়তো আবার কোনো ভোরে পুকুরপাড়ে হাঁটতে গিয়ে পানিফলের পাতায় শিশিরের ঝিকিমিকি দেখা মিলবে।