কিশোরগঞ্জ জেলার হাওড় অঞ্চলের বিস্তীর্ণ জলরাশির কোমল হাতছানি, নদীর বুকে হরেক রকম বর্ণিল নৌকার অবিরাম কোলাহল, বর্ষণমুখর দিনের নিরব আবাহন—বর্ষায় এ রকম নয়ন জুড়ানো ও হৃদয় নাড়ানো নানা অনুসঙ্গে সজ্জিত হয়ে আছে কিশোরগঞ্জের কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা নিকলী ইটনা মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম।

গত কয়েক বছর আগে নিকলী উপজেলার বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও হাওর উপজেলার সড়কগুলো সংস্কার হওয়ার সুবাদে হাওরের সৌন্দর্য উপভোগে যোগ হয়েছে ভিন্ন মাত্রা। এত দিন বিষয়টি দেশের অন্যান্য এলাকার মানুষের কাছে অজানাই ছিল। তবে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবাদে অতি অল্প সময়ে হাওর অঞ্চলের রূপের খবর ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে। ফলে নিকলী উপজেলা সহ হাওর উপজেলাগুলো ভ্রমণে আগ্রহী হয়ে উঠে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ।

ইতিমধ্যেই পর্যটকদের সরব পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে নিকলীর বেড়িবাঁধসহ হাওর উপজেলার বিভিন্ন সড়ক, যা এলাকাবাসীর মনে আশার সঞ্চার করে উৎসবের আমেজ তৈরি করেছে।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকদের গমনাগমনকে ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নিকলীসহ হাওর উপজেলাগুলোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এত দিন ধরে তারাই উপভোগ করে আসছেন। বিশ্বায়নের এ যুগে কোনো কিছুই আঞ্চলিকতায় সীমাবদ্ধ থাকে না, এটা উচিতও না। এখানে পর্যটকরা আসবেন, জলকাব্যের গহীনে হারিয়ে যাবেন—এটা তাদের জন্য আনন্দের বিষয়।খুশির বিষয়।

সবচেয়ে হতাশার কথা হলো, হাওর অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা (ট্রলার) নিয়ে ভ্রমণে আসা পর্যটকদের সাউন্ড সিস্টেমে উচ্চস্বরে গান বাজানোর ফলে এ সকল এলাকায় মারাত্মক শব্দ দূষণও হচ্ছে।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী, সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টা এবং রাত ১০টার পর উচ্চশব্দের অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ হলেও নিকলীসহ হাওর অঞ্চলের নদ নদীগুলোতে সকাল আটটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত একের পর এক আসতে থাকে পর্যটকবাহী এসব ট্রলার। আর এতে লাউড স্পিকার ও মাইকের মাত্রাতিরিক্ত শব্দে মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছেন ‘উজান ও ভাটি এলাকার সেতুবন্ধন’ খ্যাত নিকলী উপজেলার মানুষসহ কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর অঞ্চলবাসী।

এ দূষণের কারণে হাওর উপজেলা গুলোর নদী তীরবর্তী মানুষের জীবন অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছে। শব্দের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শিশু, অসুস্থ ও বয়স্করা। দিনের বেলায় শিশুদের ঘুম ও পড়াশোনোয় মারাত্মক ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়ায় দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির মুখোমুখি ভুক্তভোগীরা।এলাকার অভিভাবকদের আশঙ্কা, এ অবস্থার সমাধান না হলে বধির হওয়ার মতো অসুস্থতা নিয়ে বেড়ে ওঠবে একটি প্রজন্ম।

অজপাড়া গাঁ হওয়া সত্ত্বেও রাজধানী ঢাকা কিংবা বিভাগীয় শহরগুলোর মতো শব্দদূষণে পড়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন হাওর অঞ্চলের সচেতন এলাকাবাসী।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, শব্দদূষণের কারণে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির দেখা দেয়। উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস, বধিরতা, হৃৎকম্প, হৃদরোগ, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, আলসার, অনিদ্রা (ইনসমনিয়া), মানসিক উত্তেজনা ও উদ্বেগ (অ্যাংজাইটি), স্ট্রোক ও বিরক্তি সৃষ্টি হয়৷ এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু এবং বয়স্করা৷ শিশুদের লেখাপড়ায় মনোযোগ কমে যাওয়ার পাশাপাশি মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এমনকি গর্ভে থাকা সন্তানও শব্দদূষণে ক্ষতির শিকার হয়, অর্থাৎ তাদের শ্রবণশক্তি খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। সেই সঙ্গে তাদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিও প্রভাবিত হয় এতে।

অনিয়ন্ত্রিত শব্দে কর্মজীবীদের ভেতরে কাজের দক্ষতা ও মনোযোগ কমে যায়, সহজেই মেজাজ হারিয়ে ফেলার প্রবণতা দেখা যায়।

শব্দদূষণের আরও বেশ কিছু ঝুঁকি রয়েছে।

স্বাস্থ্য বিশষজ্ঞদের মতে, শব্দের সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ থেকে ৬০ ডেসিবেল। ৮৫ ডিবিতে শ্রবণ শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে এবং মাত্রা ১২০ ডিবি হলে কানে ব্যথা শুরু হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) মতে, ৬০ ডেসিবেলের অধিক শব্দ যদি দীর্ঘসময় ধরে থাকে তাহলে সাময়িক বধিরতা আর ১০০ ডেসিবেলের বেশি হলে স্থায়ী বধিরতা হতে পারে।

আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, শব্দের মাত্রা প্রতি ১০ ডেসিবেল বৃদ্ধিতে যেকোনো বয়সের মানুষের স্ট্রোকের ঝুঁকি ১৪ ভাগ বেড়ে যায়। আর যদি তা হয় ৬৫ বছরের বেশি বয়সে তাহলে প্রতি ১০ ডেসিবেল বাড়লে স্ট্রোকের ঝুঁকি ২৭ ভাগ করে বাড়তে থাকে!

অথচ হিসাব করে দেখা গেছে, লাউড স্পিকার ও মাইকের মাধ্যমে ১১০ ডেসিবল শব্দ নির্গত হয়, যা স্বাভাবিক মাত্রার চাইতে প্রায় আড়াই গুণ বেশি।

দূষণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে সরকার শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ বিধিমালা প্রণয়ন করে সরকার। এর আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধে সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিললে ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে৷ কিন্তু বাস্তবে সেই আইনের কোনো প্রয়োগ নেই।

হাওড় অঞ্চলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা এই প্রতিবেদককে বলেন ‘পর্যটকরা আমাদের মেহমান। এখানে এসে তারা বিশাল জলরাশির উদার সৌন্দর্য উপভোগ করবেন। অন্যদিকে তাদের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলের উপজেলা গুলো কিন্তু তাদের মাধ্যমে শব্দদূষণ হওয়ার বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত, যা অন্য সচেতন পর্যটকদের জন্যও বিব্রতকর। পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করে বিনোদনের চিন্তা আত্মঘাতী।’

এদিকে গত বৃহস্পতিবার ১২ জুন নিকলী উপজেলা সদরে নিকলী এলাকাবাসী ও মহরকোণা নবজাগরণ সমাজকল্যাণ সংস্থার উদ্যোগে শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে এক গণ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন মোহরকোনা নবজাগরণ সমাজ কল্যাণ সংস্থার সভাপতি, জনাব মাহমুদুল হাসান, মাওলানা ছিবগাতুল্লাহ আল জাবির, মাওলানা ওমর ফারুক, মুফতী আতীকুর রহমান কাসেম দৌলতী, মাওলানা আব্দুল মাজীদ কাসেমী ও হাফেজ মাওলানা আব্দুল বাছির প্রমুখ।