পূর্বাচলে নতুন শহর প্রকল্পে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম জয়নুল হক সিকদারের ১০০ একর জমি জব্দের আদেশ দিয়েছে আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনে গতকাল সোমবার ঢাকার মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ জাকির হোসেন গালিবের আদালত এ আদেশ দেয়। দুদকের সহকারী পরিচালক আশিকুর রহমান আদালতে জমি জব্দের ওই আবেদন করেন বলে সংস্থাটির জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম তথ্য দেন।

আবেদনে বলা হয়, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অনুসন্ধানে সাত সদস্যের টিম গঠন করা হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ১৯ নম্বর সেক্টর এলাকায় প্রস্তাবিত ১০০ একর (কম/বেশি) ভূমিতে ১০০/১৪২ তলা আইকনিক টাওয়ার ‘সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট’ (সিবিডি) নির্মাণে রন হক সিকদারের (জয়নুল হকের ছেলে) মালিকানাধীন ‘পাওয়ার প্যাক হোল্ডিং লিমিটেড’ এর নামে সাময়িক বরাদ্দ দেয় রাজউক।

দুদক বলছে, একটি পাতানো নিলাম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজউকের অনুমোদনে একর প্রতি ৩০ কোটি ২৫ লাখ ১০০ টাকা নির্ধারণ করে সাময়িক বরাদ্দ দেওয়া হয়। যদিও প্রতি একরের প্রকৃত বাজার মূল্য আনুমানিক ৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি ৩ হাজার কোটি টাকায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নথি পর্যালোচনা ও প্লট পরিদর্শনে দেখা যায়, ২৭০ কোটি ৫০ লাখ ১ হাজার টাকার একটি কিস্তি দিয়ে প্লট বাউন্ডারি করে সিকদার গ্রুপের নিজস্ব সিকিউরিটি ফোর্স দখলে নিয়ে নেয়। এ ছাড়া রাজউকের অনুমোদন ছাড়া এসব ভূমির একাংশে তিন তলা পর্যন্ত একটি ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে। নিজস্ব পাওয়ার হাউজ নির্মাণ করে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উন্নয়নমূলক কাজের নামে ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখার মাধ্যমে ভুয়া ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে রেকর্ডপত্র তৈরি করে ১১০ কোটি ২৭ লাখ টাকা ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণ দেখিয়ে ঋণের অর্থ স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তর করা হয়। অনুসন্ধানের এসব তথ্যের ভিত্তিতে আদালতে ১০০ একর জমির ‘সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট’ (সিবিডি) প্লট ক্রোকের আবেদন করে দুদক।

জয়নুল হক সিকদার ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি মারা যান। জয়নুল হক সিকদারের গড়া সিকদার গ্রুপের ব্যবসা ছড়িয়ে আছে ব্যাংক ও বীমা, বিদ্যুৎ, ইকনোমিক জোন, এভিয়েশন, আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মত নানা খাতে। সহযোগী কোম্পানির মধ্যে রয়েছে পাওয়ার প্যাক পোর্টস, পাওয়ার প্যাক ইকনোমিক জোন, সিকদার ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড, পাওয়ার প্যাক হোল্ডিংস, সিকদার রিয়েল এস্টেট ও মাল্টিপ্লেক্স হোল্ডিংস।

গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে ২০২৪ সালের এপ্রিলে জয়নুল হকের ছেলে সিকদার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রন হক সিকদার ও তার ভাই রিক হক সিকদারের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগে দুটি মামলাও করে দুদক।

স্ত্রীসহ টিপু মুনশির ব্যাংক হিসাব-শেয়ার অবরুদ্ধের আদেশ

সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও তার স্ত্রী আইরিন মালবিকা মুনশির ১২টি ব্যাংক হিসাব ও ১৮টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার অবরুদ্ধ এবং দুটি গাড়ি জব্দের আদেশ দিয়েছে আদালত। একইসঙ্গে টিপু মুনশির উত্তরার প্লটসহ তিনতলা ভবন, রংপুরের পীরগাছার ৯১ শতাংশ জমি এবং স্ত্রী মালবিকা মুনশির গুলশানের জমি ক্রোকের আদেশ দেওয়া হয়েছে। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সোমবার এ আদেশ দেন জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন গালিব।

দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম জানান, এদিন দুদকের সহকারী পরিচালক পাপন কুমার সাহার দুটি আবেদন আমলে নিয়ে বিচারক এ আদেশ দেন। আবেদনে বলা হয়, টিপু মুনশি ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রায় ৬ কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জন করে ভোগ দখলে রাখেন। তার ১১টি ব্যাংক হিসাবে ৩২ কোটি ১৮ লাখ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য মিলেছে। তদন্তকালে দুদক জেনেছে, সাবেক এ মন্ত্রী সম্পদ হস্তান্তর, স্থানান্তর বা বেহাত করার চেষ্টা করছেন।

আইরিন মালবিকা মুনশির আবেদনে বলা হয়, তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে সোয়া ৪ কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। এসব সম্পদ তিনি হস্তান্তর, স্থানান্তর বা বেহাত করার চেষ্টা করছেন। গত ২৯ আগস্ট ঢাকার গুলশান থেকে টিপু মুনশিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।

সাবেক প্রতিমন্ত্রী এনামুরের ব্যাংক হিসাব-শেয়ার অবরুদ্ধ ও গাড়ি জব্দের আদেশ

সাবেক দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানের সাতটি ব্যাংক হিসাব, তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা সাড়ে তিন লাখ শেয়ারের অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছে আদালত। এছাড়া দুটি গাড়ি জব্দের আদেশ দেওয়া হয়েছে। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সোমবার এ আদেশ দেন জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন গালিব।

দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম জানান, অবরুদ্ধ হওয়া শেয়ারের মধ্যে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিন লাখ ৫৯ হাজার ৫০০টি শেয়ার, এনাম অ্যাডুকেশন অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিলেজের ১০ হাজার এবং এনাম ক্যান্সার হাসপাতালের ১০ হাজার শেয়ার রয়েছে। এছাড়া এক কোটি ৪৬ লাখ টাকা মূল্যের দুটি গাড়ি জব্দ করা হয়েছে।

এদিন দুদকের সহকারী পরিচালক পাপন কুমার সাহা এ আবেদন করেন। এতে বলা হয়, আসামী নিজের ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট হিসাবের অর্থ হস্তান্তর, স্থানান্তর বা বেহাত করার চেষ্টা করছেন। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে এসব সম্পদ অবরুদ্ধ ও ক্রোক করা আবশ্যক। এর আগে গত ১০ মার্চ এনামুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।

মামলার বিবরণ অনুযায়ী, এনামুর রহমানের নামে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত ৬ কোটি ৫০ লাখ ৯২ হাজার ৭৮৫ টাকার সম্পদের তথ্য মিলেছে। এছাড়া তার পাঁচটি ব্যাংক হিসাবে ১২ কোটি ৬৯ লাখ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। গত ২৬ জানুয়ারি রাতে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে এনামুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়।

২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধসের পর আহতদের একটি বড় অংশের চিকিৎসা হয়েছিল এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এতে এনামুরের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে তাকে নৌকা প্রতীক দেয় ক্ষমতাসীন দল।

বিএনপি-জামায়াত জোটের বর্জনের সেই নির্বাচনে জনপ্রিয়তার পরীক্ষা দিতে হয়নি এনামুরকে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে সংসদে আসেন তিনি। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও একই আসন থেকে জয় লাভ করেন। ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি শেখ হাসিনার চতুর্থ মন্ত্রিসভায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তবে ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু তাকে হারিয়ে বিজয়ী হন ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইফুল ইসলাম, যিনি আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

এনএসআইয়ের সাবেক ডিজি জোবায়েরের ৫ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ

জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক টি এম জোবায়েরের ট্রাস্ট ব্যাংকের পাঁচটি হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছে আদালত। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সোমবার এ আদেশ দেন জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন গালিব। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম জানান, এসব হিসাবে ২৬ লাখ পাঁচ হাজার ৮০১ টাকা রয়েছে।

এদিন দুদকের পক্ষে কমিশনের উপপরিচালক মনজুর ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ চেয়ে আবেদন করেন। এতে বলা হয়, টি এম জোবায়েরের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা উপার্জনের অভিযোগ রয়েছে। তার নিজ ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং সাড়ে ২৯ লাখ পাউন্ডে লন্ডনে বাড়ি কেনাসহ বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে।

আবেদনে বলা হয়, ট্রাস্ট ব্যাংকের পাঁচ হিসাবের মাধ্যমে টি এম জোবায়ের ও তার স্ত্রী ফাহমিনা মাসুদ অবৈধ অর্থ স্থানান্তর করতে পারেন। এ কারণে জোবায়েরের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা প্রয়োজন। গত বছরের ৬ অক্টোবর টি এম জোবায়ের এবং তার স্ত্রী ফাহমিনা মাসুদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত।