ভোরের আলো তখনও মাটিতে পুরোপুরি পড়েনি। কাকডাকা ভোরের নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রতিদিন ভেসে আসে এক পরিচিত সুর কারো জুতো স্যান্ডেল লাগবে, ভালো ভালো স্যান্ডেল আছে, বেছে বেছে নেন, চলে গেলে পাবেন না। এই কণ্ঠস্বর ডুমুরিয়া উপজেলার গ্রামগুলোতে যেন জীবনেরই আহ্বান। খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার ধামালিয়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব হায়দার আলী মোল্যা তখন তার পুরনো সাইকেলে বোঝাই করে বের হন রঙিন জুতো, স্যান্ডেল আর নিজের সংগ্রামী স্বপ্ন নিয়ে। হায়দার আলী এই পেশায় আছেন প্রায় ৩৫ বছর। রোদ, বৃষ্টি কিংবা ঝড় কোনো কিছুই তাকে থামাতে পারেনি। প্রতিদিন সকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে তিনি সাইকেলের হর্ণ বাজিয়ে শুরু করেন দিন। দুই পাশে ঝুলে থাকে প্লাস্টিকের ব্যাগভর্তি স্যান্ডেল দেশি-বিদেশী ব্র্যান্ডের পাশাপাশি নিজের হাতে সেলাই করা কয়েক জোড়া জুতোও। তিনি বলেন, এই সাইকেলটাই আমার জীবন। এর ওপরই চলে আমার সংসার। ডুমুরিয়ার রংপুর, ধামালিয়া, রঘুনাথপুর, রুদাঘরা থেকে শুরু করে গৌরীঘোনা ইউনিয়ন সর্বত্রই তিনি জুতোর ব্যাপারী হায়দার নামে পরিচিত। মানুষ তাকে চেনে, কথা বলে, হাসে; কারও সঙ্গে চা খাওয়ার আড্ডা, কারও সঙ্গে দর-কষাকষি এই সম্পর্কগুলোই যেন তার জীবনের আসল পুঁজি।
বয়সের ভারে এখন হাঁটতে কষ্ট হয়, চোখেও স্পষ্ট দেখা যায় না। তবুও সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বাড়ি-বাড়ি ঘুরে বেড়ান তিনি। প্রতিদিন আয় হয় দুই-তিনশ’ টাকা। সেই টাকাতেই চলে পাঁচজনের সংসার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক পঙ্গু ছেলে। ছেলে আলিফ একসময় বাসের হেলপার ছিলেন। এক দুর্ঘটনায় তার এক হাত কেটে যায়। তিন লাখ টাকার চিকিৎসাতেও স্বাভাবিক হতে পারেনি সে। ছেলেকে সুস্থ করতে পারিনি। এখন আমি না বের হলে সংসার চলে না, কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে হায়দার আলীর। কোনমতে মাথাগুজার একটা বাড়ি, জমি নেই, পুঁজি নেই। তাই প্রতিদিনই তাকে নতুন করে শুরু করতে হয়। বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া শরীর, সাইকেলের টায়ার পাংচার সবই জীবনের অংশ হয়ে গেছে তার কাছে। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলেও জুতা-স্যান্ডেল বিক্রির ধরন পাল্টে গেছে। কেউ ট্রলিতে করে বিক্রি করেন, কেউ আবার মোবাইল ভ্যান নিয়ে ঘুরে বেড়ান। বাজারে বড দোকানেও এখন সস্তা পণ্য সহজলভ্য। তবুও হায়দার আলী টিকে আছেন তার মানবিক সম্পর্কের জোরে।
তিনি বলেন, মানুষ এখন অনেক বিক্রেতা দেখে। কিন্তু তারা আমাকে চেনে, কথা বলে, হাসে। আমি শুধু স্যান্ডেল বিক্রি করি না, সম্পর্ক বিক্রি করি। গ্রামের মানুষও তাকে ভালোবাসে। কেউ স্যান্ডেল কিনে বাড়তি টাকা দেয়, কেউ কেবল গল্প করে। গৌরীঘোনা গ্রামের বাসিন্দা আবদুল গফুর বলেন, হায়দার ভাই আমাদের গ্রামের পুরনো মানুষ। প্রতিদিন দেখি উনি সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ান। এমন মানুষই সমাজের আসল নায়ক।
বয়সের ভারে তিনি এখন আর আগের মতো সাইকেল চালাতে পারেন না। মাঝেমধ্যে বিশ্রাম নিতে হয়। শরীরে ব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, কিন্তু থেমে থাকা যেন তার অভিধানে নেই। ঘরে বসে থাকলে পেটের জ্বালা লাগে বেশি, বলেন তিনি হেসে। ধুলা, রোদ, বৃষ্টি সব কিছুর মাঝেও তার মুখে লেগে থাকে ঝলক হাসি। কেউ স্যান্ডেল না কিনলেও তার সঙ্গে গল্প করে। কেউ আবার বলে, হায়দার ভাই, রাখেন না, একটু বেশি দিচ্ছি। এই ভালোবাসাই যেন তার একমাত্র মূলধন। হায়দার আলীর গল্প কেবল একজন স্যান্ডেল বিক্রেতার কষ্টের কাহিনি নয় এটি বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের এক প্রতিচ্ছবি। যেখানে মানুষ টিকে থাকে প্রতিদিনের সংগ্রামে, হাসিমুখে বহন করে জীবনের ভার।
ডুমুরিয়ার এমন শত শত হায়দার আলী আজও ঘুরে বেড়ান গ্রামে গ্রামে। তারা হয়তো খবরের শিরোনাম নন, কিন্তু তাদের ঘামেই ঘুরছে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা। দিন শেষে সূর্য ডুবে গেলে হায়দার আলী ফেরেন ঘরে। হাতে থাকে কিছু বিক্রির টাকা,শরীরে ক্লান্তি কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত তৃপ্তি। কারণ তিনি জানেন, পরদিন আবার ভোরে তাকে ডাকবে সেই গান। কারো জুতো স্যান্ডেল লাগবে, ভালো ভালো স্যান্ডেল আছে, বেছে বেছে নেন এ গান তার জীবিকার, কিন্তু একই সঙ্গে এটি এক প্রান্তিক মানুষের আশা ও বেঁচে থাকার প্রতীক যেখানে সংগ্রাম থামে না, যেখানে জীবনের অর্থ হলো চলতে থাকা।