দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শিল্পনগরী খুলনা একসময় ছিল কর্মসংস্থানের শহর, নদী ও জাহাজশিল্পের গর্ব। কিন্তু গত দুই বছরে এই শহরই পরিণত হয়েছে ভয়, রক্ত ও নিঃসঙ্গতার শহরে। মাদক, এলাকা দখল, ঋণ, প্রেমঘটিত ব্যর্থতা এবং মানসিক সংকটে জর্জরিত খুলনা এখন এক গভীর সামাজিক বিপর্যয়ের মুখে। গত ১৪ মাসে ৩৮ টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। খুলনা আশেপাশের ৪ জেলার নদ-নদী থেকে গেলো ২২ মাসে উদ্ধার হয়েছে ৭৩টিরও বেশী লাশ। এছাড়া জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত খুলনায় অন্তত ৬৫ জন আত্মহত্যা করেছেন, যার মধ্যে ৮০% তরুণ (৩০ বছরের নিচে) এবং ৪০ জন নারী। খুলনা মহানগরীতেই গত ১৪ মাসে ৩৮টি লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ৩৪% হত্যার পেছনে রয়েছে মাদক কারবার ও এলাকা দখলের আধিপত্য। গত জুলাই ও আগস্ট মাসেই ঘটে ৭টি হত্যাকান্ড।

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে টানা তিন দিন তিনটি হত্যাকান্ড ঘটে। ১ অক্টোবর দৌলতপুরে ঘুমন্ত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয় তানভীর হাসান শুভ (২৯)। ২ অক্টোবর সোনাডাঙ্গায় মাদকাসক্ত ছেলের হাতে খুন হন বাবা লিটন শেখ (৫৫)। ৩০ সেপ্টেম্বর হোটেলকর্মী প্রিন্সের (২৫) লাশ উদ্ধার করে রেলওয়ে পুলিশ। নৃশংসতার চিত্র আরও স্প’ হয় খালিশপুরের হত্যাকান্ডে, যেখানে এক নারী নিজের স্বামী-সন্তানদের নিয়ে প্রতিবেশীকে হত্যা করেন সুদের বিরোধে। খুলনা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশনস) মোহাম্মদ রাশিদুল ইসলাম খান বলেন, মাদকসহ অন্যান্য অপরাধে পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তবে পারিবারিক কারণে যে হত্যাকান্ডগুলো ঘটছে, সেগুলো প্রতিরোধে সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক যোগাযোগ বাড়ানো এখন জরুরি। তিনি জানান, পুলিশ ইতোমধ্যে নগরীর ১২৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক কাউন্সেলিং কর্মসূচি সম্পন্ন করেছে এবং ইজি বাইক চালকদেরও প্রশিক্ষণ দিয়েছে, যাতে তারা এলাকায় অপরাধীদের বিষয়ে তথ্য দিতে পারে। নৌ-পুলিশের তথ্য মতে, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও পিরোজপুর জেলার বিভিন্ন নদ-নদী থেকে গত ২২ মাসে উদ্ধার হয়েছে ৭৩টিরও বেশি লাশ। এর মধ্যে ২৭ জনের পরিচয় মেলেনি। এদের মধ্যে বেশিরভাগই হত্যাকান্ডের শিকার, যাদের স্থলভাগে হত্যা করে প্রমাণ ন’ের জন্য নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

খুলনা নৌ-পুলিশ সুপার ড. মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন আমরা তিন ধরনের লাশ পাই দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা, এবং হত্যাজনিত। এর মধ্যে হত্যাকান্ডজনিত লাশই বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্থলভাগে হত্যা হয়, পরে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। তিনি আরও জানান, গত বছরের তুলনায় ২০২৫ সালে লাশ উদ্ধারের সংখ্যা বেড়েছে। অর্ধগলিত লাশ শনাক্তে সমস্যা হচ্ছে, ফলে অনেক হত্যাকারী অধরাই থেকে যাচ্ছে।

২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত খুলনায় অন্তত ৬৫ জন আত্মহত্যা করেছেন, যার মধ্যে ৮০% তরুণ (৩০ বছরের নিচে) এবং ৪০ জন নারী। মানসিক চাপ, প্রেমঘটিত ব্যর্থতা, বেকারত্ব ও পারিবারিক বিরোধকে এ মৃত্যুর মূল কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এই আত্মহত্যাগুলোর পেছনে লুকিয়ে আছে অসহায়ত্বের ভাষা। ৯ জুন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহফুজা আফরিন (২৩) লিখে যান সুইসাইড নোটেও মিথ্যা লিখে যাওয়া শ্রেয় মনে হয়, পাছে কেউ যদি পড়ে হাঁসে। ১৯ আগস্ট কলেজছাত্রী তিসা (১৯) আত্মহত্যার আগে লেখেন বাবা-মা, আমাকে ক্ষমা করে দিও। এক মাসেই খুলনা মেডিকেলে ৩৬ জন আত্মহত্যার চে’ায় ভর্তি হয়েছেন।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সাইফুল ইসলাম রাজু বলেন, বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করে, আর বাংলাদেশে প্রতি ৪০ মিনিটে। দেশের মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ এখন আত্মহত্যা। তিনি আরও বলেন, মানসিক চাপ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, পারিবারিক দূরত্ব এই তিনটি কারণই মূল চালক। পরিবারকে সন্তানের মানসিক অবস্থা বোঝার সময় দিতে হবে। সরকারি সুন্দরবন কলেজ এর মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী বলেন, তরুণরা মানসিকভাবে চাপে পড়লে তারা দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শক কেন্দ্র গড়ে তুললে এই প্রবণতা অনেকটা কমানো সম্ভব। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুলনার বর্তমান পরিস্থিতি দুটি সংকটকে স্প’ করছে অপরাধ ও হত্যা নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্খলার দুর্বলতা ও তরুণ সমাজে মানসিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ঘাটতি। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার খুলনা সমন্বয়কারী এডভোকেট মোমিনুল ইসলাম বলেন, ৫ আগস্টের পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির দিকে। সন্ত্রাসীরা এলাকায় ফিরে আসছে, পুলিশও আগের মতো সক্রিয় নয়। দ্রুত বিচার নিশ্চিত না হলে অপরাধীরা আরও সাহস পাবে।