রাজশাহী অঞ্চলে আগুনে পোড়া রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। গত এক বছরে হাসপাতালে চিকিৎসা নেয় পাঁচ সহস্রাধিক। এদের ৬০ ভাগই শিশু। অসাবধানতাই প্রধান কারণ বলে জানা গেছে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গত বছর ২০২৪ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এক বছরে রামেক হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ওয়ার্ডের আওতায় বর্হিবিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে ৫ হাজার ১৩৮ জন পোড়া রোগী। এর মধ্যে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয় ২ হাজার ৭১ জন। যাদের প্রায় ৬০ ভাগই হলো শিশু। এর পরে আছে নারী প্রায় ৩০ ভাগ এবং পুরুষ ১০ ভাগ। হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের ৫১টি শয্যায় ভর্তিকৃত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। আর বর্হিবিভাগে সপ্তাহের ৫ দিন। ফলোআপ চিকিৎসা দেয়া হয় সপ্তাহের তিন দিন।
একটি ক্ষেত্রে দেখা যায়, গত ২ আগস্ট গোদাগাড়ী উপজেলা সদর এলাকার ওসমান আলীর শিশু কন্যা তাবাসসুম (২) রাজশাহী হাসপাতালে ভর্তি হয় শরীরের প্রায় ২৫ শতাংশ দগ্ধ হয়ে। ওসমান আলীর বাড়িতে রাইস কুকারে দুধ জাল করার পরে অসাবধানতাবশত সেই দুধ পড়ে যায় শিশুটির শরীরে। এতে মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয় অবুঝ শিশুটি। পরে তাকে রাজশাহী হাসপাতালে নেয়া হলে একদিন চিকিৎসা শেষে পরের দিন ঢাকা বার্ন ও প্লাস্ট্রিক সার্জারি হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শিশুটির অবস্থা গুরুতর ছিল। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের শরীরের ২৫ ভাগ পুড়ে গেলেই সে ঝুঁকিতে পড়ে। সেখানে মাত্র দুই বছরের শিশুর এতো পুড়ে যাওয়ায় তার অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক। তাকে আইসিইউতে নিতে হতো। রাজশাহী হাসপাতালে পোড়া রোগীদের জন্য আলাদা আইসিইউ না থাকায় শিশু তাবাসসুমকে ঢাকায় পাঠানো হয়।
দুর্ঘটনার কারণ: অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু তাবাসসুমই নয়, এমন অসাবধানতা ও অসেচতনতার কারণে রাজশাহী অঞ্চলে বেড়েই চলেছে পোড়া রোগীদের হার। অধিকাংশ পোড়া রোগী আসছেন রান্না ঘরে খাবার রান্না করতে গিয়ে দগ্ধ হওয়া। যাদের বড় অংশই হলো শিশু। এর পরে আছে নারী। হাসপাতাল সূত্র মতে, চলতি মাসের গত ৩০ জুলাই শরীরের প্রায় ২ ভাগ পোড়া নিয়ে বার্ন ইউনিটের চিকিৎসা নিতে আসে মাত্র ১৪ মাস বয়সী শিশু অনিক। তার বাড়ি নগরীর বোয়ালিয়া থানা এলাকায়। ইলেক্ট্রিক কেটলিতে করে দুধ গরম করতে গিয়ে সেই দুধ শিশু অনিকের শরীরে গিয়ে পড়ে। এতে দগ্ধ হয় শিশুটি। গত তিন আগস্ট এ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিতে আসে রাজশাহীর তানোর এলাকার এক চিকিৎসকের দুই বছরের শিশু সন্তান। তার শরীরও পুড়ে যায় রাইস কুকারে জাল করা গরম দুধ থেকে।
রাজশাহী হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট সূত্র মতে, হাসপাতালে গড়ে এখন ১৩ জন পোড়া রোগী চিকিৎসা নিতে আসছে। রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলা ছাড়াও উত্তরাঞ্চল এমনকি দক্ষিণাঞ্চলের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহসহ আরও বিভিন্ন জেলার পোড়া রোগী এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে। তাঁদের প্রায় ৯০ ভাগই হলো অসেচতনতায় দগ্ধ হওয়া। আর বাকি ১০ ভাগ আসে বিভিন্ন দুর্ঘটনা থেকে। এই পোড়া রোগীদের একটি বড় অংশই রাইস কুকার, ইলেক্ট্রিক কেটলি, ইলেক্ট্রিক জগ পানি বা দুধ গরম করতে গিয়ে দগ্ধ হওয়া।
রামেক হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের একজন চিকিৎসক জানান, যেসব পোড়া রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে, তাদের অধিকাংশ হলো অসেচতনতায় দগ্ধ হওয়া। বলা যায় অন্তত ৯০ ভাগই পোড়া রোগী অসেচতনতায় দগ্ধ হয়ে আসে চিকিৎসা নিতে। যাদের মধ্যে অধিকাংশই রান্না ঘরে ব্যবহৃত ইলেক্ট্রিক জিনিসপত্রে গরম দুধ বা পানি থেকে দগ্ধ হয়। ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হলে এসব পোড়া রোধ করা অনেকটাই সম্ভব। কিন্তু যেনতেনভাবে রান্নার ঘরে ইলেক্ট্রিক জগ, কেটলি ও রাইস কুকার ব্যবহারের কারণে পোড়া রোগীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তিনি আরো বলেন, আগে শুধু শীতকালে পোড়া রোগী বেশি হতো। এখন অসেচতনতার কারণে গরম কালেও পোড়া রোগী আসছে ব্যাপক হারে। যাদেও মধ্যে অধিকাংশই আক্রান্ত হচ্ছে শিশু। এটি আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।