নুরুল আমিন মিন্টু, চট্টগ্রাম ব্যুরো : প্রায় তিন দশক ধরে ৪৬টি ফিশিং ভ্যাসেল কোনো ধরনের সরকারি রাজস্ব পরিশোধ না করেই সমুদ্রে মৎস্য আহরণ করে আসছে। এসব ফিশিং ভ্যাসেলের মধ্যে কোনোটি ২৭ বছর, কোনোটি ২৫ বছর, আবার কোনোটি ২০ বছর ধরে সরকারের কাছে কোনো রাজস্ব পরিশোধ করছে না। “ট্রায়াল” বা পরীক্ষামূলক কার্যক্রমের নাম করে বছরের পর বছর ধরে এসব ফিশিং ট্রলার সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণ চালিয়ে যাচ্ছে। এই সুযোগের অপব্যবহার করে এসব জাহাজের মালিকরা রাতারাতি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়ে যাচ্ছেন। যা সমুদ্র সম্পদ, জীববৈচিত্র্য ও মৎস্য প্রজননের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর। এসব ট্রলারের মৎস্য আহরণ বন্ধ করা গেলে অতিরিক্ত আহরণের লাগাম টেনে ধরা যেত বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। নিবন্ধিত বাণিজ্যিক মৎস্য ট্রলারের মালিকরা বলছে, আমরা সরকারকে রাজস্ব দিয়ে মৎস্য আহরণ করছি। আরেকটি গ্রুপ কোনো প্রকার রাজস্ব না দিয়ে মৎস্য আহরণ করছে। ফলে কোনো প্রকার জবাবদিহিতা তাদের নেই। তারা আইন-কানুন, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণ করছে। ধরছে টনে টনে জাটকা। খরচ না থাকায় বিক্রি করছে কমদামে। ফলে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে নিবন্ধিত বাণিজ্যিক মৎস্য ট্রলারের মালিকরা।

ভ্যাসেলগুলো হল-এফ.ভি স্যাটালাইট ২. ফিশ হান্টার, ইউনিকো-১৫, সালাম-২, বিসমিল্লাহ, মেরিন হারভেস্টার-২, সী বার্ড, পাওয়ার সোর্স-১, সাফা -১, জুট্টি, সাতকানিয়া -১, সী হারভেস্ট, শহীদুল -১, মা আমেনা-১, সাগর-১, আর . হাসান – ১, আর. হাসান -২, শাহাপুরী-১, গাঙচিল -১, টাজ-১, এস এন্ড এ অফ বে অফ বেঙ্গল, মায়া, ষ্টার -১, মায়া-১, আফিফ -১, সী কুইন-১, সাদিয়া, জুয়েল, সোনার বাংলা, সুরমা, এসএস সী ষ্টার-৩, রেইনবু-২, জাহান মুনি -১, জাহান মুনি -২, হুমাইরা-১ (সমুদ্রে নিখোঁজ), সিনোমেসি-২৯ (অচল), রেইনবু -১ (প্রতিস্থাপনের জন্য অনুমোদিত), শাহাবাদর-২ (ডুবে গেছে), অরিয়ন-১ (অস্তিত্বহীন), ড্রিম সী-১ (অস্তিত্বহীন), গোল্ড সী-১ (সমুদ্রে নিখোঁজ), আনওয়া হালওয়া-১ (ডুবে গেছে), তুহফা (অচল), এস এস সী স্টার-১ (অচল), ৪২. মুন স্টার (অচল). চম্পা (অস্তিত্বহীন)।

জানা গেছে, ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে “দি মেরিন ফিশারিজ অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৩” নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, যা সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য প্রণীত হয়েছিল। এটি “সামুদ্রিক মৎস্য আইন, ১৯৮৩” নামেও পরিচিত। এই আইনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা। এই অধ্যাদেশ জারি করার আগে সমুদ্রে মৎস্য আহরণের কোনো নিয়ম-কানুন ছিল না। যেনতেনভাবে সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণ করা হতো। এই অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সমুদ্রে মৎস্য আহরণের ওপর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হয়। মৎস্য আহরণের জন্য প্রথমে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে হয়। মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ লাইসেন্সের অনুমতি দিলে ফিশিং ভ্যাসেল বিদেশ থেকে আমদানি অথবা দেশে তৈরি করতে হবে। ফিশিং জাহাজ প্রস্তুত হলে নৌ বাণিজ্য দপ্তর থেকে নিবন্ধন নিতে হয়। এরপর নিতে হয় মৎস্য আহরণ করতে সমুদ্র যাওয়ার উপযুক্ততা যাচাই সনদ। তারপর নিতে হয় সমুদ্র যাত্রার অনুমতিপত্র। সরকারি এসব সনদ নেওয়ার পর একটি ফিশিং ভ্যাসেল সমুদ্রে মৎস্য আহরণ করতে যেতে পারে।

সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছে, কোনো প্রকার সরকারি আইন-কানুন, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে লাইসেন্স দাবি করেন ৪৬টি ফিশিং ভ্যাসেলের মালিকরা। তাদের দাবি অনুযায়ি লাইসেন্স না দিলে উচ্চ আদালতে মামলা করেন তারা। আদালত মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের “ট্রায়ালে” মৎস্য আহরণের অনুমতি দেন। ১৯৯৮ সাল থেকে এফভি স্যাটেলাইট-১ এর মাধ্যমে ট্রায়ালের নিয়ম চালু হয়েছে। সেই নিয়মেই চলছে এসব ফিসিং ভ্যাসেল। ৪৬টি ফিশিং ভ্যাসেলের মধ্যে ৩৪টি সচল রয়েছে। বাকি ১২টির মধ্যে সমুদ্রে নিখোঁজ আছে ২টি, প্রতিস্থাপনের জন্য অনুমোদিত হয় ১টি, অচল আছে ৪টি, ডুবে গেছে ২টি ও অস্তিত্বহীন রয়েছে ৩টি।

সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ৪৬ টি জাহাজ ট্রায়ালে মৎস্য আহরণের জন্য আদালতের আদেশ রয়েছে। এরমধ্যে অকার্যকর রয়েছে ১২টি জাহাজ। একটি জাহাজ থেকে লাইসেন্স ও নবায়ন ফি নেয়া হয় বছরে ১৫ হাজার টাকা। বছরে অন্তত ২০ বার সমুদ্রে মাছ ধরতে যায় একেকটি জাহাজ। একবার মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য এসপি (সেইলিং পারমেশন) নিতে সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তরকে ফি দিতে হয় ২ হাজার টাকা। একটি জাহাজ থেকে এসপি বাবদ বছরে আদায় হওয়ার কথা ৪০ হাজার টাকা। লাইসেন্স ও নবায়ন এবং এসপি ফি বাবদ একটি জাহাজ থেকে সরকার বছরে রাজস্ব পাওয়ার কথা ৫৫ হাজার টাকা। ৪৬টি জাহাজ থেকে বছরে ২লাখ ৫৩ হাজার টাকা রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা। ২৭ বছরে ৪৬টি জাহাজ থেকে সরকারি রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা ৬ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে যোগ হয়েছে আহরণ ফি। প্রতি টনে ১শ’ টাকা হারে আহরণ ফি আদায় করা হচ্ছে। প্রায় তিন দশক ধরে এসব ট্রলারের রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত সরকার।

সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তর চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মো. মশিউর রহমান বলেন, ২০১৯ সালের সামুদ্রিক মৎস্য জরিপ ব্যবস্থাপনা ইউনিট কর্তৃক প্রকাশিত সার্ভে প্রতিবদনে সমুদ্রে মৎস্য আহরণে নিয়োজিত ট্রলার সংখ্যা কমিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়। এসব ট্রলারের মৎস্য আহরণ বন্ধ করা গেলে অতি আহরণের লাগাম টেনে ধরা যেত বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।