হাসিনা সরকারের আমলে ২০১৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে দৈনিক সংগ্রাম কার্যালয়ে ঢুকে সাংবাদিক কর্মচারীদের অবরুদ্ধ করে নির্বিচারে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে ব্যাপক তান্ডব চালানো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্যার এএফ রহমান হলে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এএসএম আল সনেটকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে।
তবে তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও সমকামিতাসহ আরও বহু অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদেরকে শিবির ট্যাগ দিয়ে নির্যাতন, ভয় দেখিয়ে হল ত্যাগে বাধ্য করা, হল থেকে তুলে নেয়া, অপহরণসহ মব সৃষ্টির অভিযোগ হয়েছে। সনেট কখনো ছাত্রলীগ নেতা, কখনো মুক্তযোদ্ধ মঞ্চ আবার কখনো মুক্তিযোদ্ধ প্রজন্ম লীগের নেতৃত্বে থেকে ফ্যাসিস্ট সরকারের লাঠিয়াল হয়ে কাজ করেছে। বিরোধী কণ্ঠ রোধে মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ ও মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগের নামে সস্ত্রাসী বাহিনী গঠন করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল সনেট।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ডিসি মিডিয়া তালেবুর রহমান জানিয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্রলীগ নেতা ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের ঢাবি সভাপতি এ এস এম আল সনেটকে সোমবার রাতে রাজধানীর বেইলি রোড থেকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাকেসহ গত দুই দিনে আরও ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদেরকে গতকাল মঙ্গলবার আদালতে পাঠানো হয়েছে। ডিবি জানিয়েছে, সনেটের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল, ঢাবি ক্যাম্পাসে শিবির সন্দেহে ছাত্রদের নির্যাতন, বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন দমন, সংবাদপত্র কার্যালয়ে হামলা ও পত্রিকার সম্পাদককে মারধরের অভিযোগ রয়েছে। আল আমিন সনেট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা ছিলো। মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম লীগের সভাপতির দায়িত্বে ছিল। তার বাড়ি বরিশাল জেলার মুলাদি উপজেলা সফিপুর ইউনিয়নে। পিতার নাম মৃত আব্দুর রহিম মাস্টার।
দৈনিক সংগ্রাম অফিসে তান্ডব: প্রতিদিনের মতো সেদিনও কর্মব্যস্ত ছিলেন দৈনিক সংগ্রামের নিউজরুমসহ অন্যান্য বিভাগের সংবাদকর্মীরা। আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর হওয়ায় ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের রোষানলে ছিল দেশের প্রাচীনতম পত্রিকা দৈনিক সংগ্রাম। ২০১৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের দোসর ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামে একটি ভূঁইফোড় সংগঠনের নেতা-কর্মী পরিচয়ে কতিপয় দুর্বৃত্ত জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে অতর্কিতে রাজধানীর মগবাজারে দৈনিক সংগ্রামের প্রধান কার্যালয়ে ঢুকে নির্বিচারে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। তারা লাঠিসোটা নিয়ে সম্পাদকের কক্ষে গিয়ে বাংচুর করে। অস্ত্রের মুখে পত্রিকাটির প্রবীণ সম্পাদক ও প্রকাশক, লেখক, কলামিস্ট আবুল আসাদকে লাঞ্চিত করে অন্যায়ভাবে চ্যাংদোলা করে টেনেহিঁচড়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয় তারা। এসময় পত্রিকার কম্পিউটারসহ প্রকাশনার সমস্ত যন্ত্রাংশ অচল করে দেয়া হয়। হামলাকারীরা প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ধরে পত্রিকাটির অফিসের বার্তাকক্ষসহ বিভিন্ন কক্ষে ব্যাপক ভাংচুর করে। তা-ব চলাকালে সংবাদকর্মীরা কার্যালয়ের ভেতরে অসহায়ের মতো অবস্থান করেন। তারা পত্রিকাটির সম্পাদকের কক্ষ, বার্তাকক্ষ, চীফ রিপোর্টারের কক্ষ, সম্পাদনাসহকারী, সহ-সম্পাদকের কক্ষসহ প্রতিটি কক্ষে তা-ব চালায়। এতে প্রায় দেড় কোটি টাকার ক্ষতি হয় পত্রিকাটির। তবে এই হামলা চলাকালে দৈনিক সংগ্রাম কার্যালয়ের সামনে বিপুল সংখ্যক পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তারা সেদিন সাংবাদিকদের রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। পুলিশ সদস্যরা বাইরে থেকে হামলাকারীদের রক্ষার দায়িত্বে ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়। সম্পাদক ও প্রবীণ সাংবাদিক আবুল আসাদকে জোরপূর্বক অফিস থেকে ধরে বাইরে নিয়ে পুলিশে দেয়ার পর তাকে হাতিরঝিল থানা হেফাজতে নেয়া হয়। বয়োজ্যেষ্ঠ এই সম্পাদককে থানা হেফাজতে রেখে পরদিন আদালতে পাঠানো হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানা যায়, সেদিন বিকেল সোয়া ৫টা থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধের মঞ্চ’ নামের ওই ভূঁইফোড় সংগঠনের নেতা আমিনুল ইসলাম বুলবুল, সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন ও এএসএম আল সনেটের নেতৃত্বে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে দৈনিক সংগ্রাম মগবাজারে কার্যালয়ে প্রবেশ করে। এর আগে বিকাল থেকে ৫০-৬০ জন যুবক মগবাজার ওয়ারলেস রেল গেট সংলগ্ন সংগ্রাম অফিস অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘেরাও করে হুমকিমূলক স্লোগান দেয়। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ কেন্দ্রীয় কমিটির নামে সংগঠনটির সভাপতি। হামলাকারীরা ৫৮টি কম্পিউটার, ৩টি টেলিভিশন, এয়ার কন্ডিশনার, পত্রিকার সার্ভার, প্রিন্টার, দরজা-জানালা আসবাবপত্র ভাংচুর করে। পত্রিকা অফিসের ভেতরে তারা প্রায় একঘণ্টা ধরে এ তান্ডব চালায়। এছাড়া কক্ষগুলোতে থাকা চেয়ার-টেবিল, টেলিভিশন, এ্যালুমেনিয়ামের দরজা-জানালায় ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। এরপর হামলাকারীরা সম্পাদক আবুল আসাদের কক্ষে যায়। তারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে প্রবীণ এই সম্পাদককে। এ সময় কয়েকজন হামলাকারী সম্পাদক আবুল আসাদকে টেনে হেঁচড়ে দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত তার কক্ষ থেকে অফিসের বাইরে নিয়ে যায়। তার সাথে থাকা সহকারী মো. কামরুজ্জামানকে এলোপাতাড়ি কিল, ঘুষি ও লাথি মারতে থাকে। হামলাকারীরা প্রবাীণ এই সম্পাদককে বিভিন্ন মিডিয়ার সামনেও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। তাকে জোরপূর্বক নানা ধরনের বক্তব্য দিতে বাধ্য করে দুর্বৃত্তরা।
ভূঁইফোড় সংগঠনের ভূঁইফোড় নেতা: কথিত সংগঠন মুক্তিযোদ্ধ মঞ্চের আল আমিন সনেট, আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও আল-মামুন নামে নামে রয়েছে বহু সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগ। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সন্ত্রাসী বাহিনী হিসেবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে টার্গেট করে তারা হামলা চালিয়েছে। এসব করে বিরোধী মতের লোকজনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল ও চাঁদাবাজি করতো দুর্বৃত্তরা। সংগ্রামে হামলার পর ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরসহ তার অনুসারীদের ওপর হামলার ঘটনায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আল মামুন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক ইয়াছিন আরাফাত তূর্যকে আটক করে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। ২০১৯ সালের ২২ ডিসেম্বর দুপুরে দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভবনে ভিপি নুরুল হক নুর ও তার অনুসারীদের ওপর হামলা চালায় সনেট, বুলবুল, আল মামুনসহ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের দুবৃৃত্তরা। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিতে হয়েছে নুরসহ প্রায় পাঁচজন নেতাকর্মীকে।
আসিফ নজরুলের কক্ষে তালা: বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলকে ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে তাকে চাকরিচ্যুতসহ গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট বিকেল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধনে এ দাবি জানানো হয়। পরে আসিফ নজরুলের কুশপুত্তলিকা দাহ করে সংগঠনটি। একই সঙ্গে আইন অনুষদে আসিফ নজরুলের অফিসে তালা দেয় তারা। তখন প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মুক্তিযুদ্ধের মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আল মামুনের নেতৃত্বে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা বিকেল পৌনে ৫টায় আইন বিভাগে প্রবেশ করেন। এ সময় তারা এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দিতে তার কক্ষে তালা লাগান।
সমকামিতার অভিযোগ: ২০১৯ সালের ২ ডিসেম্বর সনেটের বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগ তোলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের এবং জগন্নাথ হলের আবাসিক শিক্ষার্থী স্বপন রায়। স্ট্যাটাসে লিখেন, “সত্য লুকিয়ে মিথ্যা প্রচারে আমার শিক্ষা জীবন এখন হুমকির মুখে। টিএসসিতে একা চা খাচ্ছিলাম। তখন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ, ঢাবি শাখার সভাপতি আল সনেট ভাই এসে আমার পরিচয় জানতে চাইলেন, আমি পরিচয় দিলাম, আমি স্বপন রায়, জগন্নাথ হল, যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ প্রথম বর্ষ। পরিচয় দেবার পর আমাকে বলে বাইকে উঠো, চা খেয়ে আসি, আমি তাকে আগে থেকেই চিনতাম তাই নির্দ্বিধায় তার বাইকে উঠলাম। তিনি আমাকে রমনা পার্কে নিয়ে গেলেন। নিয়ে যাওয়ার কিছু সময় কথা বলার পর তিনি আমাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যান, এরপর অগ্নি শিখার এক কোণে নিয়ে আমাকে কুপ্রস্তাব দেন এবং জবরদস্তি করেন। তখন আমি বুঝতে পারি, তিনি সমকামী। তারপরে আমি বাঁচার উদ্দেশ্যে তাকে মিথ্যা বললাম, ভাই আমার কালকে এক্সাম আছে, আমাকে হলে গিয়ে ঘুমাতে হবে। বাইকে উঠে জগন্নাথ হল গেটের সামনে এসে বাইক থামান এবং উনি আবার অশ্লীল কিছু ইংগিত করেন। তখন রাগের মাথায় কয়েকটা থাপ্পড় মারি। আর উনি মার খাওয়ার ভয়ে বাইক ফেলে বাইকের চাবি নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যান। এর আগে ২০১৫ সালের এপ্রিলে সমকামিতার অভিযোগে সনেটকে পিটিয়ে হলছাড়া করার অভিযোগ রয়েছে।